যে সকল ভবিষ্যৎবাণীগুলো সংঘটিত হয়ে গেছে তার কিছু সংখ্যক এখানে তুলে ধরা হলো।
১। মদীনা মুনাওয়ারাহ থেকে আগুনের আত্মপ্রকাশ
সাহাবী আবু হুরায়রা রাঃ. বলেন, যতক্ষণ না হেজাজ থেকে একটি আগুন প্রজ্বলিত হয়ে বুসরার (বসরার) উটগুলোর ঘাড়কে আলোকিত করে দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘঠিত হবে না। (সহীহ মুসলিম ৭০২৫)
এ হাদীসে যে আগুনের কথা বলা হয়েছে তা ৬৫০ হিজরির জমাদিয়ুস সানী মাসের এক শুক্রবারের মাদীনার কোনো এক উপত্যকা থেকে এ আগুনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এবং প্রায় এক মাস পর্যন্ত বহাল ছিল। বসরার অধিবাসীরা সাক্ষ্য দিয়েছে যে, এ আগুনের আলোকে বসরার উটগুলোর ঘাড়গুলোকে আলোকিত করেছিল। (৩য় বিশ্বযুদ্ধ, মাহাদী ও দাজ্জাল: আসেম ওমর ২৫-২৬ পৃ)
২। লাল ঝঞ্ঝা বায়ু ও মাটি ধসে যাওয়া
সাহাবী আলী বিন আবু তালিব (রা:) বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, আমার উম্মত যখন ১৫টি স্বভাব ধারণ করবে, তখন তাদের ওপর নানা ধরনের বিপদ আপতিত হবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! সেগুলো কোন কোন স্বভাব?
রসূল ﷺ বললেন, ১- যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে যখন নিজের সম্পদ মনে করা হবে। ২- আমানতকৃত সম্পদকে যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মনে করা হবে। ৩। যাকাত প্রদান করাকে জরিমানা মনে করা হবে। ৪- পুরুষ নিজ স্ত্রীর আনুগত্য করবে। ৫- মায়ের অবাধ্যতা করবে। ৬-বন্ধুদের সাথে সদাচরণ করবে। ৭- পিতার সাথে অসদাচরণ করবে। ৮- মসজিদগুলোতে কথার শব্দ উঁচু হবে। ৯- জাতির সবচেয়ে হীনব্যক্তি শাসক হবে। ১০- অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে নিকৃষ্ট মানুষকে সম্মান দেখানো হবে। ১১- মদ ব্যাপকভাবে পান করা হবে। ১২- পুরুষরা সিল্কের কাপড় পরিধান করবে। ১৩- মেয়েরা গায়িকা ও নায়িকা হবে। ১৪- বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হবে। ১৫- উম্মতের পরবর্তীলোকেরা পূর্ববতী লোকদের অভিশম্পাত করবে। তখনই তুমি লাল ঝঞ্ঝা বায়ু, মাটি ধ্বসে যাওয়া অথবা চেহারা বিকৃত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থেকো। (আল- মু’জামুল আওসাত- ১/১৫০ পৃ.)
উদারতার নামে এই ধ্বংসাত্বক স্বভাবগুলো মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এগুলো সবই ঘটে গেছে। এখন শুধু সেই আযাব আসা বাকি রয়েছে।
৩। মসজিদগুলোকে সুসজ্জিত করা
সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা:) বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘঠিত হবে না যতক্ষণ না মানুষ মসজিদগুলোর সুসজ্জিত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। (সহীহ ইবনে খুযায়মাহ ২/২৮২)
অর্থাৎ মসজিদে আসার সময় এমনভাবে আসবে যার মধ্যে নিজের বিত্ত ও প্রভাব দেখানোর মানসিকতা বিরাজ করবে। প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলের তুলনায় নিজেদের মসজিদগুলোকে আরও বেশি সুন্দর নির্মাণে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।
রসূল ﷺ বলেছেন, যখন কোনো জাতির পাপ বেড়ে যায়, তখনই সমাজের মসজিদগুলো সুসজ্জিত করা হয়। আর দাজ্জালের আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে না আসা পর্যন্ত মসজিদগুলো সুসজ্জিত করা বন্ধ হবে না। (আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান ৪/৮১৯পৃ.)
সে জন্যে সাহাবী আবুদ্দারদা (রা:) বলেছেন, তোমরা যখন মসজিদগুলো সাজাবে এবং কুরআনের কপিগুলো (বিভিন্ন নকশায়) অলঙ্কৃত করবে, তখন বুঝে নিবে, তোমাদের ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেছে। (কাশফুল খাফা ১/৯৫)
মানুষ যখন আল্লাহর দাসত্ব পরিত্যাগ করে মানুষের গোলামিতে লিপ্ত হয়, তখন মানুষের চিন্তা-চেতনা উল্টে যায়। বর্তমান যুগে কোনো এলাকায় যদি সুদৃশ্য মসজিদ নির্মিত না হয় তাহলে মনে করা হয় আল্লাহর সাথে ঐ এলাকার লোকদের কোনো সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে যে এলাকায় একটি সুদৃশ্য মসজিত নির্মিত হয় সে এলাকার লোকগুলোকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও খুব দ্বীনদার মানুষ মনে করা হয়। কিন্তু কারোই সঠিক খবর নেই যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে তাদের মূল্যায়ন কী। আর বর্তমানে কুরআনকে এমন সুন্দর ও চাকচিক্য করে সাজিয়ে, লেখাগুলোতে বিভিন্ন কালার দিয়ে ছাপানো হচ্ছে যা পরের হাদিসকেই বাস্তবায়ন করে। এরকম আর আগের কোন জামানায় হয়নি।
৪। মুনাফিকও কুরআন পাঠ করবে
সাহাবী আবু হুরায়রা রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের জীবনে এমন একটি যুগ আসবে তখন কুরআন পাঠ বেড়ে যাবে, দ্বীন বোঝার মত মানুষ কম হবে, কুরআনের জ্ঞান তুলে নেওয়া হবে আর হারজ বেশি হবে। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! হারজ কি? তিনি বললেন, হারজ হলো পারস্পরিক খুনাখুনি/ গণহত্যা। তারপর এমন একটি সময় আসবে যখন মানুষ কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারপর এমন একটি সময় আসবে যখন মুনাফিক, ফাসিক ও মুশরিকরা মুমিনদের সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হবে। (আল মুসতাদরাক ৪/৫০৪ পৃ)
সাহাবী আবু আমীর আশআরী রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, আমি যে ব্যাপারটি আমার উম্মতের জন্য আশঙ্কা অনুভব করছি তার মধ্যে বেশি আশঙ্কাজনক বিষয়টি হলো, তারা বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যাবে, যার ফলে তারা একে অপরকে হিংসা করবে এবং আপসে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। আর তাদের জন্য কুরআন পড়া সহজ হয়ে যাবে। ফলে সৎকর্মপরায়ন পাপিষ্ঠ ও মুনাফিক সবাই কুরআন পড়বে, তারা সমাজে অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কুরআনের সূত্র নিয়ে মুমিনদের সাথে তর্ক-বিবাদে লিপ্ত হবে। অথচ কুরআনে এমন কিছু আয়াত আছে যেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু যারা গভীর জ্ঞানের অধিকারী, তাঁরা বলবে আমরা এই কুরআনের উপর পুরোপরি ঈমান রাখি। (আল-আহাদীসুল মাসানী ৪/৪৫৩)
উল্লেখ্য যে, আমাদের এই যুগটিই সেই যুগ। এ যুগে নানা জাগতিক বিধানের বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। কিন্তু দ্বীনের বিধান বিদ্বান মানুষের সংখ্যা কম। একেবারেই নগণ্য। কুরআন হাদীস তথা ইসলাম বুঝবার মানুষ খুবই অল্প। জাগতিক বিদ্যার মানুষ তো অনেক চোখে পড়ে, কিন্তু দ্বীনের জ্ঞানের অধিকারী মুসলমান খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। এ দিকে মানুষের আগ্রহ খুবই কম। এ যুগে সম্পদের আধিক্য একটি ব্যাপক বিষয়। যার ফলে যত সব বিভধান্ত এবং অনাচারের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কুরআন পড়া এত সহজ হয়ে গেছে যে, পৃথিবীর অধিকাংশ মাতৃভাষায় তা উচ্চারণে পড়া যাচ্ছে। ফলে কারো যদি সরাসরি আরবী বর্ণে কুরআন পড়ার যোগ্যতা নাও থাকে সে ইচ্ছে করলে নিজ ভাষায় উচ্চারণে মুদ্রিত ও প্রকাশিত কুরআন পড়তে পারছে। ফলে সাধারণ মুসলিমগণ উপকৃত হলেও ফাসিক (দূরাচার) মুনাফেকদেরও (কপটারী) কুরআন পড়তে দেখা যাচ্ছে।
শুধু তাই নয় ঐ শ্রেণীর লোকেরা কোন রকম যোগ্যতা ছাড়াই কুরআন বিষয়ে মতামত প্রদান করছে। সেসব লোক যাদের ইসলাম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই তারা কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ) করছে। তারা আল্লাহর কুরআনের সে সব আয়াতে মতামত দিচ্ছে যেগুলোর জ্ঞান আল্লাহ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।
৫। আমল উঠে যাওয়া
সাহাবী যিয়াদ বিন লাবীদ (রা:) বলেন, রসূল ﷺ কে কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেন এটা ঐ সময়ে হবে, যখন জ্ঞান উঠে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর রসূল! জ্ঞান কীভাবে উঠে যাবে? অথচ আমরা কুরআন পড়ি, আমাদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দেই, আর তারাও তাদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দেয় এবং এ ধারাবহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তিনি বললেন, ওহে যিয়াদ! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক, আমি তোমাকে মদীনার বুদ্ধিমানদের মধ্যে অন্তরগত বলে মনে করতাম। তাহলে এটা কি ঠিক নয় যে, ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা তাদের তাওরাত (বাইবেল) ও ইঞ্জিল পড়ে। কিন্তু তাতে যা আছে তার উপর তারা আমল করে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২/৪০৪৮)
অর্থাৎ মুসলমানদেরকে কুরআন শুধু পড়লে হবে না, কুরআনে যে নির্দেশনা আছে তার উপর সকল মুসলিমদেরকে আমল করতে হবে। অন্যথায় হাদীসে বর্ণিত নিয়মে কুরআনের জ্ঞান তুলে নেওয়া হবে। যা বর্তমান মুসলিম সমাজে কুরআনের জ্ঞানহীন লোকদের চাক্ষুস দেখা যাচ্ছে।
৬। সময় দ্রুত অতিবাহিত হওয়া
কিয়ামত যত নিকটবর্তী হবে সময় তত দ্রুত অতিক্রম করবে। বছর মাসের সমান, মাস সপ্তাহের সমান, সপ্তাহ এক দিনের সমান ও এক দিন এক ঘণ্টার সমান মনে হবে। সাহাবী আবু হুরায়রা (রা:) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন, রসূল ﷺ বলেছেন, কিয়ামতের আগে আগে সময় দ্রুত অতিক্রম করবে। মানুষ কম আমল করবে, কৃপণতা বৃদ্ধি পাবে, ফিতনা (গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা) বেড়ে যাবে, হারজ বৃদ্ধি পাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল ﷺ হারজ কী? তিনি বললেন, ব্যপকহারে হতাহত হওয়া। (সহীহ বুখারী ৭০৬১)
সাহাবী আবু হুরায়রা রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, সে সময় পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না সময় পরস্পর খুব কাছাকাছি হয়ে যাবে। সে সময় বছর মাসের সমান, মাস সপ্তাহের সমান, সপ্তাহ দিনের সমান, দিন ঘণ্টার সমান, আর ঘণ্টা খেজুরের শুকনো পাতা বা ডালের প্রজ্বলনের সময়ের সমান হয়ে যাবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান ৫/২৫৬)
অর্থাৎ, সময়ের বরকত চলে যাবে। এ যুগে আমরা বিষয়টা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি যে, সময়ের বরকত অনেক কমে গেছে। দিন দিন এটি আরো কমতেই থাকবে। সপ্তাহ, মাস ও বছর কোন ফাঁকে কিভাবে চলে যাচ্ছে টেরই পাওয়া যাচ্ছে না।
৭। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদ ﷺ কিয়ামত আগমণের পূর্বে যে বিষয়গুলোর ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন, তার মধ্যে বিস্ময়কর বাণী হলো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। যে যুগে আধুনিক প্রযুক্তির কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না সে যুগেই নবী ﷺ এর ব্যবহারের ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন। দূর নিকটে হয়ে যাবে এবং বিভিন্ন উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবে তার কথাও বলা হয়েছে।
৮। পক্ষাঘাত ব্যাধি ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “মানুষের কৃতকর্মের দরুণ জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের কতিপয় কৃতর্কমের স্বাদ (শাস্তি) তাদেরকে আস্বাদন করান। যাতে তারা আল্লাহর পথে ফিরে আসে।” (সূরা রূম- ৩০/৪১)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, “তোমাদেরকে যে সব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে হচ্ছে। অনেক গুনাহ তো আল্লাহ তাআলা ক্ষমাই করে দেন।” (সূরা শূরা, আঃ ৩০)
সাহাবী আনাস ইবনে মালেক রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, পক্ষাঘাত ব্যাধির মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটবে। এমন কি মানুষ রোগকে মহামারী ভাবতে শুরু করবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক- ৩/৫৯৭)
উল্লেখ্য যে, জলে ও স্থলে তথা সারা বিশ্বের মানুষের কু-কর্মের কারণে যে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, সে বিপর্যয় বলতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলির প্রাচুর্য, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম হওয়া এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিপদাপদ বুঝানো হয়েছে। যা বর্তমান সময়ে স্বাভাবিক অবস্থা মনে করে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। (তাফসীরে কুরতুবী)
আর মানবতার শত্রুদের পক্ষ হতে মানুষের ওপর এমন “ভাইরাস” আক্রমন করা হবে, যা পক্ষাঘাত ব্যাধির কারণ হবে।
৯। আলেমগণের মৃত্যু
"কিয়ামতের আগে প্রচুর পরিমাণে আলেমগণ মৃত্যুবরণ করবেন, আর অজ্ঞলোকেরা মুফতি সেজে লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করবে।"
সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমের রাঃ. বলেন, আমি রসূল ﷺ কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা দ্বীনের ইলম বা জ্ঞান বান্দাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবেন। তবে আলেমগণের মৃত্যুর মাধ্যমে দ্বীনের জ্ঞান উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন একজন আলেমও অবশিষ্ট থাকবে না, তখন লোকেরা অজ্ঞলোকদের নিজেদের পথ প্রদর্শক রূপে গ্রহণ করবে। তাদেরকে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হবে, আর তারা অজ্ঞতা নিয়ে ফতোয়া দিবে। এতে করে নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং লোকদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে। (সহীহ মুসলিম ৬৬৮৯ / ১৩ / ২৬৭৩)
রসূল ﷺ বলেছেন, “আলেমদের জীবনে এমন একটি সময় আসবে, যখন তাদের এমনভাবে হত্যা করা হবে, যেভাবে চোরদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আহ্, সেদিন যদি আলেমগণ নির্বোধের মত ভান করত।” (আত-তাকরীব: ২ / ৩৩১ পৃ)
সাহাবী আবু হুরাইরা রাঃ. বলেন, আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি যাঁর হাতে আমার জীবন, নিঃসন্দেহে আলেমগণের জীবনে এমন একটি সময় আসবে, যখন তাঁদের কাছে লাল স্বর্ণের চেয়েও মৃত্যু বেশি প্রিয় হবে। (মুস্তাদরিক হাকিম ৮৫৮১ পৃ)
বর্তমানে দ্বীনের বিরুদ্ধবাদী লোকেরা সত্যের মোকাবেলায় মিথ্যার চুড়ান্ত যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও শ্রেষ্টত্বের বোধ-বিশ্বাস ও চেতনাকে মুসলমারদের হৃদয় থেকে মুছে দিয়ে মানুষদেরকে ইবলিসিয়্যাত ও দাজ্জালিয়্যতের পথ প্রশস্ত করার কাজে ব্যস্ত করে ফেলেছে। বর্তমান এই সময়টি সম্পর্কেই মহানাবী ﷺ আমাদেরকে সতর্ক হতে বলেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন।
১০। আরব দেশগুলোর উপর অবরোধ আরোপ
সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, সেই সময়টি অতি নিকটে, যখন ইরাকিদের উপর অর্থ ও খাদ্যের অবরোধ আরোপ করা হবে। নাবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করা হলো, এই অবরোধ কার পক্ষ থেকে আরোপ করা হবে? তিনি বললেন, অনারবদের পক্ষ থেকে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, সেই সময়টিও বেশি দূরে নয়, যখন সিরিয়াবাসীদের উপরও অবরোধ আরোপ করা হরে। জিজ্ঞেস করা হল, এই অবরোধ কার পক্ষ থেকে করা হবে? তিনি উত্তরে বললেন, রোমের (পশ্চিমাদের) অধিবাসীদের পক্ষ থেকে। (মুস্তাদরাক হাকিম -৪/৪৫৬)
ইরাকের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ এর ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। রোম বলতে পশ্চিম জোটকে বুঝানো হয়েছে। কেননা ইহুদী-খৃষ্টানদের তীর্থভূমি জেরূজালেম হলেও রোমের বর্তমান ভ্যাটিকান সিটিই তাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের স্থান। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বলেন, সেই সময়টি অতি নিকটে, যখন কান্তুরা জনগোষ্ঠী (পাশ্চাত্যবাসী) তোমাদেরকে ইরাকের মাটি থেকে বের করে দিবে। একথা শুনে আমি বললাম, আমরা কি পরে ফিরে আসতে পারব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, পরে তোমরা ফিরে আসবে এবং স্বচ্ছল ও স্বাচ্ছন্দময় জীবনযাপন লাভ করবে (অর্থাৎ দ্বীন আবার প্রতিষ্ঠিত হবে)। (আস-সুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান- ৪/২৭২)
১২। আরব ভূমি ঝর্ণা ও সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ হবে
সাহাবী আবু হুরায়রা রাঃ. বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যতক্ষণ না আরব ভূমি সবুজ ঘাস ও ঝর্ণায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এমনকি কোনো আরোহী ইরাক থেকে নির্বিঘ্নে মক্কায় পৌঁছে যাবে, অথচ তার কোনো ভয় থাকবে না, তবে শুধু রাস্তা হারানোর ভয় থাকবে। (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ১২৪৭৪)
১৩। অট্টালিকা নির্মাণ
আবু হুরায়রা রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, যখন মেষ পালকের রাখালেরা সুরম্য অট্টলিকায় বসবাস করবে, তখন কিয়ামত অতি নিকটে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হা- ৫/৪০৪৪)
বর্তমানে এই অট্টালিকা নির্মাণ যেভাবে হচ্ছে তা আর কোন যুগে হয়নি এবং আর কখনো হবেও না। কারণ সবকিছুর একটি চূড়া আছে এবং সেই পর্যন্ত পৌঁছে আবার আগের জায়গায় তা ফেরত আসবে অর্থাৎ ধ্বংস হবে।
১৪। বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা
শহর-নগরীর ধ্বংস হওয়া বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোতে “খারাবুন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দটি পুরোপুরি হোক কিংবা আংশিক— সব ধরণের ক্ষয়ক্ষতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সেজন্য আমরা “খারাবুন” শব্দটির অর্থ “ক্ষয়ক্ষতি” বুঝবো। কারণ হাদীসে বর্ণিত প্রতিটি দেশের ক্ষয়ক্ষতি একটি থেকে অপরটি ভিন্ন।
কেননা, সাহাবী সাওবান রাঃ. বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, খাদ্যগ্রহণকারীরা খাবারের চতুর্দিকে যেভাবে একত্রিত হয়, অচিরেই বিজাতিরা তোমাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই একত্রিত হবে। এক ব্যক্তি বলল, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরকম হবে?
রসূল ﷺ বললেন, না, বরং তোমরা সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। কিন্ত সেদিন তোমরা প্লাবনের শ্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত হবে। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের পক্ষ থেকে আতঙ্ক দূর করে দেবেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভীরুতা ভরে দিবেন। কারণ তোমরা দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন থাকবে আর মৃত্যুকে অপছন্দ করবে। (সুনানে আবু দাউদ ৫/৪২৯৭)
হযরত সাঈদ ইবনে মোসায়েব (রা:) হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, একটা যুদ্ধ হবে যার শুরুতে থাকবে শিশুদের খেলা (ছোটদের খেলা থেকেই যুদ্ধ শুরু হবে)। যুদ্ধটা এমন হবে যে, এক দিক হতে থামলে অন্যদিক হতে তা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। যুদ্ধ থামবে না এমন অবস্থায় আসমান থেকে জিবরাঈল (আঃ) বলবেন, অমুক ব্যক্তি তোমাদের নেতা। আর ইবনে মোসায়েব (রা:) বলেন, (আহবানকারী) তাঁর দুই হাত গুটাবেন ফলে তাঁর হাত দুটা সংকুচিত হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি এই কথাটি তিনবার বললেন, সেই নেতাই সত্য।
- (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৯৭৩; আস সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ৭৫৭)
হযরত ইবনুল মুসাইয়িব (রা:) হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন সিরিয়ায় একটি যুদ্ধ হবে। যার শুরুটা হবে শিশুদের খেলাধূলা (দিয়ে)। অতঃপর তাদের এ যুদ্ধ কোন ভাবেই থামবে না। আর তাদের কোন দলও থাকবে না। এমনকি আকাশ থেকে এক সম্বোধনকারী সম্বোধন করে বলবে, তোমাদের উপর অমুক ব্যক্তি। এবং সুসংবাদদাতার হাত উত্থিত হবে।
- (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৯৭৭)
হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন চতূর্থ ফিতনা বা যুদ্ধ ১২ বছর স্থায়ী হবে। যখন অবসান হওয়ার তখন অবসান হবে। (অর্থাৎ ১২ বছর সময় শেষ হবে তারপর) স্বর্ণের পাহাড় থেকে ফুরাতকে খুলে দেওয়া হবে (প্রকাশ পাবে)। অতঃপর তার উপর (অর্থাৎ তাতে) প্রত্যেক নয় জনের সাত জনকে হত্যা করা হবে।
- (যঈফ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৯৭০)
এ বিষয়ে জানা যায়- ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ১৪ বছর বয়সী ৭ম শ্রেণীর ছাত্র মুয়াইয়া সিয়াসনেহ টেলিভিশনে তিউনেশিয়া ও মিশরের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী খবর দেখে দক্ষিণ সিরিয়ার দারা শহরে নিজের স্কুলের দেয়ালে সরকার বিরোধী স্লোগান লেখে। বিবিসি এর নিউজ মতে এক ছোট ছেলে খেলাধুলার বসে দেয়ালে লিখে ‘বাশার (শাসক) তোমাকে চলে যেতে হবে’। আর সেখানে নিয়ম ছিল প্রেসিডেন্ট এর নামের আগে সম্মানজনক কিছু উল্লেখ করা। তারপর রাতের বেলা পুলিশ এসে তাকে সহ আরো ৩ বন্ধুকে আটক করে মারাত্মক নির্যাতন করে। কিছু খবরে আসে সেই আটককৃতদের থেকে একজন নির্যাতনের কারণে মারাও যায়। এই ঘটনার পর অভিভাবকরা ও সমাজের লোকেরা রাস্তায় মিছিলে নামে। যার কারণে দারা শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে, এবং পরবর্তীতে যা পুরো সিরিয়াতে ছড়িয়ে পরে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে বাশার আল আসাদ সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং তাদেরকে নির্দেশ দেয় বিক্ষোভকারীদের সরাসরি গুলি করতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কেউ কেউ সাধারণ জনগণকে গুলি করতে অস্বীকার করে। তারপর সেনাবাহিনীর সেই বিদ্রোহী অংশটি নিয়ে গঠিত হয় FSA অর্থাৎ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। তারপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরব দেশের মিত্ররা বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। অর্থাৎ এই এখানে অনেকগুলো দল একসাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। যা এখনো চলমান। আর এটাই হচ্ছে সিরিয়া যুদ্ধ তথা চতুর্থ ফিতনা।
দেখা যাচ্ছে হাদিসের সাথে হুবহু এই যুদ্ধের সূত্রপাতের সাথে মিলে যাচ্ছে। তাহলে এই ফিতনা শুরু হওয়ার ১২ বছর পর ফুরাতের ফিতনা ঘটিত হবে। এই হিসেবে-
২০১১+১২=২০২৩ সালের দিকে বা তার কিছু পরই ফুরাত নদীতে স্বর্ণের পাহাড় বা খনি উন্মোচিত হবে ও তা নিয়ে যুদ্ধ হবে।
0 মন্তব্যসমূহ