২.১ জাহেরি ইলম ও বাতেনি ইলম বা ইলমে লাদুনী কি?

ইলমকে অনেকে অনেকভাবে ভাগ করেছেন। তবে সাধারণভাবে ইল্‌ম দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ

১। জাহেরি ইল্‌ম বা ইলমে কাসাবী।

২। ইলমে লাদুনী।

১। জাহেরি ইলম (প্রকাশ্য জ্ঞান): জাহেরি ইলম (প্রকাশ্য জ্ঞান) হচ্ছে কুরআন, সুন্নাহ তথা হাদিস, ইজমা-কিয়াস অর্থাৎ এক কথায় বলতে শারিয়াহ। এগুলো সব আমাদের কাছে প্রকাশ্য জ্ঞান এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া। অজু করার পদ্ধতি, কুরআন পড়ার জ্ঞান, ইসলামী শরীয়তী বিধিবিধান ও ফিকহ সম্পর্কিত জ্ঞান, যা আমাদের শেষ রসূল ও নবী এর মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে। যা আমরা প্রচেষ্টা করলেই অর্জন করতে পারি, জানতে পারি এবং যেটাকে ইসলামী জ্ঞানার্জনও বলতে পারি।

২। ইলমে লাদুনী (আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান): এটি আল্লাহ তায়ালা হতে পাওয়া বিশেষ জ্ঞান। যা আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে দান করতে পারেন। এই জ্ঞান কোন প্রচেষ্টা দ্বারা অর্জন সম্ভব নয়। এটি কোন রকম প্রচেষ্টা ছাড়াই আসে। যেমন ওহী, ইলহাম, কাশফ বা স্বপ্নের মাধ্যমে। তবে ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে গেছে।

ইলম মানে জ্ঞান/বিজ্ঞান। লাদুনী মানে পক্ষীয়। সৃষ্টিজগত সম্পর্কিত যে বিশেষ জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-ওলীগণের বিশেষ কাউকে দেওয়া হয়, সেটিই হলো ইলমে লাদুনী। আর যে জ্ঞান মানুষ নিজের চেষ্টায় অর্জন করে, সেটি হলো ইলমে কাসাবী (অর্জন সাপেক্ষ জ্ঞান)।

ইলমে লাদুনী আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা দান করে থাকেন। নুবুওয়াতের ন্যায় এটিও চেষ্টা করে অর্জনের বিষয় নয়। সূরা কাহাফ পড়ার পরও যদি কোনো মুসলিম ইলমে লাদুনীর কথা অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কোরআন অস্বীকারের দায়ে কাফির/বেঈমান বলা যাবে।

ইলমে লাদুনীর কথা কোরআন মজীদের সূরা কাহফে আলোচিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে:

فَوَجَدا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آَتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا

অর্থঃ অতঃপর তাঁরা উভয়ে (হযরত মূসা ও হযরত ইউশা আঃ) আমার বান্দাদের এমন একজনের দেখা পেলেন, যাঁকে আমি আমার কাছ থেকে বিশেষ রহমত দান করেছি এবং তাঁকে আমি আমার পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি। (সূরা কাহফ, আঃ ৬৫)

এই জামানায় ইলমে লাদুনি বা আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান সম্পর্কে বলা খুবই ভয়ংকর একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অনেক মানুষ আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ জ্ঞান বলতে এখন কিছুই বিশ্বাস করে না। তারা বলে সব জ্ঞান প্রকাশ্য। বিশেষ জ্ঞান বলতে কিছু নেই। এগুলো মানুষের ধোঁকাবাজি মনে করেন। রসূল কোন বিষয় আমাদের অনবগত করে যান নি আরো ইত্যাদি ব্যাখ্যা। আবার অনেকে এটাকে সুফিবাদ এর একটা ব্যাপার বলে ধরে নেয়। এই বিষয় নিয়ে এত বিভ্রান্তি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাতেনি ইলম বা ইলমে লাদুনি তথা আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ জ্ঞান এর কথা মাজার পূজারীরাও বলে থাকে, তারা বলে থাকে তাদের আর নামাজ-রোজা এর দরকার নেই, তারা বাতেনি ইলম পেয়ে গেছে বা মারিফত পেয়ে গেছে। যদিও তারা মিথ্যা বলে এ ব্যাপারে, কিন্তু ইলমে লাদুনী এর প্রতি অবশ্যই ঈমান রাখতে হবে। আমাদের মিথ্যার মধ্য থেকে সত্যটা বের করে গ্রহণ করতে হবে এবং সত্যের মধ্য থেকে মিথ্যাকে বের করে তা বর্জন করতে হবে। তাই বলে ঢালাও ভাবে বলা কোনমতেই উচিৎ না যে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ জ্ঞান বলতে কিছু নেই। এই বিষয়ে আগামীতে একটি বই লেখা হতে পারে যাতে ইসলামে সঠিক তাসাউফ ও শরীয়তে এর অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে ইনশাআল্লাহ।

এখানে আমাদের যুগের সাথে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) এর যুগের একটি পার্থক্য করবো। কারণ ইসলামে তাসাউফ নিয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া এর যুগে যে অবস্থা হয়েছিল বর্তমানে ঠিক তার উল্টো অবস্থা বিরাজমান। কি সেই পার্থক্য-

তার যুগের অবস্থা- সাহাবী ও তাবেঈদের যুগ থেকে খালেস ইসলামী তাসাউফের একটি ধারা চলে আসছিল। এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনই ছিল এর একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। কিন্তু পরবর্তীতে এর কর্মধারায় নানা আবর্জনা এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে গেল যে, মুসলিমদের এক বিরাট গোষ্ঠিও এই আবর্জনা ধোঁয়া পানি পান করেই আত্মতৃপ্তি লাভ করতে লাগল। হিজরী অষ্টম শতকে এসে সুফীবাদ এক গোমরাহী ও ভ্রান্ত মতবাদে পরিণত হয়। তাসাউফের লেবাস ধরে নির্ভেজাল ইসলামী আকীদাহর বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রীক দর্শন, সর্বেশ্বরবাদ, অদ্বৈত্ববাদ ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আবর্জনা মিশ্রিত সুফীবাদের দাবীদাররা ইলমকে যাহেরী-বাতেনীতে বিভক্ত করতে থাকে, একজনের বক্ষদেশ থেকে অন্যজনের বক্ষদেশে জ্ঞানের গোপন বিস্তার হয় বলে প্রচার করতে থাকে এবং কামেল পীর-মুরশিদ ও আল্লাহর প্রেমে পাগল ভক্তের জন্য শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার প্রয়োজন নেই ইত্যাদি ভ্রান্ত চিন্তা-বিশ্বাস তাসাউফের নামে মুসলিমদের বিরাট এক অংশের উপর চেপে বসে। আল্লাহর অলী ও তাঁর নেক বান্দাদের ব্যাপারে অমুসলিমদের ন্যায় মুসলিমরাও বাড়াবাড়ি শুরু করে। তাদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে এবং নিজেদের দিলের মাকসুদ পূরা করতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেমগণও অলীদের কবরে ধরণা দিত।

ইসলামের নামে এই সব জাহেলীয়াতের অন্ধকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করে খালেস তাওহীদের দিকে মুসলিমদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন একজন মর্দে মুজাহিদের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাওহীদ ও শির্কের পার্থক্য সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে অবগত, জাহেলীয়াতের সকল চেহারা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে যিনি ওয়াকিফহাল এবং যিনি জাহেলীয়াতের মূলোৎপাটন করে মুসলিমদের জন্য সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবী ও তাবেঈদের আমল থেকে নির্ভেজাল আকীদাহ ও আমল তুলে ধরবেন। এই গুরু দায়িত্বটি পালন করার জন্য হিজরী অষ্টম শতকে আল্লাহ তাআলা ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহকে চয়ন করেন। তিনি মুসলিমদের সামনে ইসলামের পরিচ্ছন্ন আকীদাহ্ বিশ্বাস তুলে ধরেন এবং সকল প্রকার শির্ক-বিদআত থেকে ইসলামকে পরিশুদ্ধ করেন।

-        (শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া, ডঃ সালেহ ফাওযান)

আমাদের যুগ- বর্তমানে আমরা ইনশাআল্লাহ সেই সকল সংস্কারকদের কঠিন সংগ্রামের কারণে সঠিক আকিদাকে গ্রহণ করে নিয়েছি। আজ পৃথিবীতে অসংখ্য মুসলিমরা সহীহ আকিদার উপর রয়েছে, অন্তত সেই সকল ভ্রান্ত সূফীবাদ থেকে দূরে রয়েছে যা ইবনে তাইমিয়া (রঃ) এর সময় ছিল। কিন্তু এখন বর্তমানে দেখা যায় সহীহ আকিদা করতে করতে মুসলিমরা ইসলামের সঠিক তাসাউফকেও বাদ দিয়ে দিয়েছে। অলীদের থেকে কারামত প্রকাশ পেতে পারে তা তারা বিশ্বাস করে না। তারা কোন ব্যক্তি থেকে অলৌকিক কিছু দেখলেই মনে করে এগুলো শয়তানের পক্ষ থেকে হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে না। কোন বিষয়টি শরীয়ত পরিপন্থী আর কোন বিষয়টি শরীয়ত অনুমোদন দেয় সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে না। ইবনে তাইমিয়া (রঃ) এর যুগে যেখানে ইলহাম-কাশফ দিয়ে দলিল সাব্যস্ত করে তার উপর আমল করতো সেটিকে তিনি ভারসাম্য পর্যায়ে নিয়ে এসে বলেছেন যে তা দিয়ে দলিল সাব্যস্ত হয় না এবং শরীয়তের পরিপন্থী কোন আমলও সাব্যস্ত হয় না। কিন্তু তিনি একথা বলেন নি যে, ইলহাম-কাশফ এর কোন ভিত্তি নেই বা এগুলো অপ্রয়োজনীয়। বরং তিনি এগুলোতে বিশ্বাস রাখাকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত এর আকিদার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বর্তমানে ঠিক এটাই হয়েছে যে এগুলোকে ভিত্তিহীন, অপ্রয়োজনীয় বা এগুলো সম্পর্কে আরো আপত্তিকর কথা হচ্ছে। সেই যুগে যেমন এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছে, আমাদের যুগে এখন এগুলো নিয়ে ছাড়াছাড়ি হচ্ছে। যেগুলো ইসলামের মৌলিক আকিদার সাথে সাব্যস্ত সেগুলোই এখন কাটছাট করে আমরা সহীহ আকিদা তৈরি করেছি। এখন বর্তমানে অবস্থা উল্লেখ করে কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে- যদি আমাদের সামনে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কারামত প্রকাশিত হয়ে পরে তাহলে সেটাকে শয়তানের ভেল্কি বা ইস্তিদরাজ বলে মনে করি। আবার কেউ ভবিষ্যতের কোন বিষয় আল্লাহর পক্ষ থেকে জানতে পারলো কিন্তু এ বিষয়ে শরীয়তের জ্ঞান না থাকার কারণে একে গায়েবের জ্ঞান জানা দাবি করে সেই লোককে তাকফির করা হয়। এগুলো কিছু মাত্র উদাহরণ যাতে বর্তমান অবস্থা বুঝা যায়। এরকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে যা ইসলামে শরীয়তে রয়েছে কিন্তু এই যুগে তা কাটছাট করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, কোন রাহবার বা দ্বীন সংস্কারক এগুলোকে আবার সংস্কার করবে।

তবে আমরা বর্তমান জামানার অবস্থা বুঝতে পারি এরকম ভাবে যে কেন তারা যেকোনো বিষয়কে হালে শয়তান বা শয়তানের পক্ষ থেকে বলে থাকে। বর্তমান জামানায় বিভিন্ন ফিরকা এবং ভণ্ডের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। আগের যুগের সেই সকল বাতিল আকিদার, বাতিল ফিরকার লোকজন এখনো সমাজে বিদ্যমান। মানুষ এখন ধোঁকাবাজ, বেঈমান ও মুনাফিকের আখলাক বহন করে। আর পৃথিবীতে যে শয়তানের অনুসারী বেশি সেটাও সবার জানা। ঈসা (আঃ) এর পানিতে হেটে নদী পার হওয়ার মুজেজার ঘটনা আমরা জানি। অনেক আউলিয়া থেকেও এরকম কারামত হয়েছে বলে জানি। কিন্তু বর্তমানে যদি কেউ এরকম নদীতে পানির উপর হেটে যায় তাহলে এক বাক্যেই এটিকে শয়তানের ভেল্কী, জীনের দ্বারা করেছে, জাদু দিয়ে করেছে বা প্রযুক্তি দিয়ে এরকম করেছে বলবে। কারণ আসলে এই সকল মাধ্যমেই এগুলো করা হয়ে থাকে এই জামানায়। সকলেরই একটি বিশ্বাস এখন আর সেই আগের যুগের মতো আল্লাহ ওয়ালা লোক অর্থাৎ আল্লাহর অলি নেই। এটা অনেকটা সত্যও কিন্তু একদমই যে নেই তা নয়। এই সকল বিষয় নিয়ে অতিরঞ্জিত করে মানুষের কাছে উপস্থাপন করে অসংখ্য মুমিন ব্যক্তিকে গোমরাহ বানানোর ইতিহাসও অনেক বড়। এই ইসলামী তাসাউফে ভেজাল ঢুকে যাওয়ার কারণে তাকে পরিশোধন করে সঠিক অবস্থায় না এনে একে একদমই ছুড়ে ফেলা হয়েছে বর্তমান জামানায়। এর কারণ চারিদিকে শুধু ভ্রান্ত তাসাউফ, ভন্ডদেরই ছড়াছড়ি। আর মাজার পূজারী-কবর পূজারীরা মারিফত ও আল্লাহর কারামত পেয়ে গেছে দাবি করে শরীয়তকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। তাই এই তাসাউফকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যদিও ভন্ডদের থেকে বাঁচতে পারছে, কিন্তু সাথে সঠিক তাসাউফকেও ভেজাল বলে সঠিক ব্যক্তি বা কোন আল্লাহর পক্ষ থেকে কারামত বা ইলহাম-কাশফকেও ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যা একটি মারাত্মক বিষয়। তাই বর্তমানে আকিদা সংশোধন করতে গিয়ে আমরা এই মারিফত-কারামতই বাদ দিয়ে দিয়েছি আর ভাবছি এগুলোর কোন ভিত্তি নাই, অপ্রয়োজনীয়। এই বিষয়টি নিয়ে জ্ঞানার্জনেরও কোন প্রয়োজন বোধ করে না বলে তাদের সামনে সঠিক কোন বিষয় আসলেও তারা তাকে ভেজাল জিনিস মনে করে ফেলে দেয়। এটিই আমাদের নতুন করে সংস্কার করতে হবে।

বর্তমান যুগে কি পার্থক্য বিদ্যমান এটি জানার পর আমাদের এ সকল বিষয়ে কি আকিদা রাখতে হবে তাও জানা আবশ্যক। এই বিষয়ে আমাদের আকিদা হতে হবে-

শাইখুল ইসলাম ইমাম তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَمِنْ أُصُولِ أَهْلِ السُّنَّةِ: التَّصْدِيقُ بِكَرَامَاتَ الأَوْلِيَاءِ وما يُجْرِي اللهُ عَلَى أَيْدِيهِم مِنْ خَوَارِقِ الْعَادَاتِ فِي أَنْوَاعِ الْعُلُومِ وَالْمُكَاشَفَاتِ وَأَنْوَاعِ الْقُدْرَةِ وَالتَّأْثِيرَاتِ والْمَأْثُورِ عَنْ سَالِفِ الأُمَمِ فِي سُورَةِ الْكَهْفِ وَعَنْ صَدْرِ هَذِهِ الأُمَّةِ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ وَسَائِرِ فِرَق الأُمَّةِ وَهِيَ مَوْجُودَةٌ فِيهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহর অন্যতম মূলনীতি হলো অলীদের কারামত এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদের হাতে অলৌকিক ও স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত যে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করেন, তারা তাতে বিশ্বাস করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদের হাতে বিভিন্ন প্রকার ইলম ও কাশ্ফ থেকে যা প্রকাশ করেন এবং তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব থেকে তাদের মাধ্যমে যা কিছু প্রকাশ করেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতে বিশ্বাস করে।

পূর্বের জাতিসমূহের মধ্যে যেসব কারামত সংঘটিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা কাহাফে এবং অন্যান্য সূরায় যেসব কারামতের কথা বর্ণনা করেছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতে বিশ্বাস করে। সেই সাথে এই উম্মতের প্রথম যুগে সাহাবী, তাবেয়ী এবং পরবর্তীতে আগমণকারী উম্মতের সকল ফির্কার লোকদের মধ্যে প্রকাশিত যেসব কারামতের কথা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতেও বিশ্বাস করে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, এই উম্মতের মধ্যে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কারামত প্রকাশিত হওয়া অব্যাহত থাকবে।

- (৬৬. কারামতে আওলীয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব, শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া, ডঃ সালেহ ফাওযান)

এই সকল বিশেষ জ্ঞান এর মধ্যে রয়েছে অদৃশ্যের কিছু খবর জানানো তা অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎও হতে পারে, স্বপ্নের সঠিক তাবীর করার জ্ঞান ইত্যাদি। এই সকল বিশেষ জ্ঞান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন এবং তিনি যতটুকু চান ঠিক ততটুকুই এবং তা বিভিন্ন অলি-আউলিয়াগণ পেয়ে থাকেন যা আমরা বিভিন্ন সহীহ দলিলে প্রমাণ পাই। তাদের সরাসরি ইলহাম না হয়ে অনেক সময় স্বপ্ন বা কাশ্ফ যোগেও হয়ে থাকে এটি। অর্থাৎ আল্লাহ তাকে বিশেষ জ্ঞানটি কোন মাধ্যমে দিচ্ছেন তাও তার ইচ্ছাধীন।

তবে ইমাম ও আল্লাহর মনোনীত খলীফা-বান্দারা, মুজাদ্দিদরা সরাসরি ইলহামপ্রাপ্ত হন ও তাদের সরাসরি অন্তঃকরণ হয়ে থাকে। আর তারা ইলমে লাদুনি এর অধিকারী হয়ে থাকেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, রসূল বলেছেন, আমার উম্মতের আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার হলো তারা ইলহাম পাবে। যেমন আমার জামানায় উমর (রা:) পেয়েছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল ইলহাম কি? তিনি বললেন, গোপন ওহী বা বার্তা। যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলবেন।

-        (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস, ইবনে দায়লামী ৭৯৬)

আবূ তাহির আহমদ ইবনু আমর ইবনু সারহ (রহঃ) ... আয়িশা (রা:) সুত্রে নবী থেকে বর্ণিত। তিনি বলতেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতসমূহের মধ্যে কিছু লোক ছিলেন মুহাদ্দাস, আমার উম্মাতের মধ্যে যদি কেউ এমন থেকে থাকে তবে সে উমার ইবনুল খাত্তাবই হবে।

ইবনু ওয়াহব বলেন মুহাদ্দাস এর ব্যাখ্যা হল যার প্রতি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) ইলহাম হয়।

-        (সহীহ, সহীহুল মুসলিম ইসঃ ফাঃ ৫৯৮৭)

আবূ হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির মধ্যে অনেক মুহাদ্দাস লোক ছিল। যদি আমার উম্মতের মধ্যে কেউ মুহাদ্দাস থাকে, তাহলে সে হল উমার।

-   (সহীহ, সহীহুল বুখারী ৩৪৬৯, ৩৬৮৯; সহীহুল মুসলিম ২৩৯৮; রিয়াযুস স্বা-লিহীন ২/১৫১২; সুনান আত তিরমিযী ৩৬৯৩; মুসনাদে আহমাদ ২৩৭৬৪, ৮২৬৩)

হযরত আবু মাসউদ উকবা ইবনে আমর আনসারী আল বদরী (রা:) বলেন, রসূল বলেছেন, পূর্ববর্তী যুগে আল্লাহ তা'আলা বনি ইসরাইলের নিকট বারো জন ইমাম পাঠিয়েছিলেন, আর তারা ছিল ওহী প্রাপ্ত। আর আমার উম্মতদের মধ্যেও বারো জন ইমাম থাকবে, যারা আল্লাহর নির্দেশনা (ইলহাম) পাবে।

-        (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস, ইবনে দায়লামী ৭৯৭)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ