আমাদের বর্তমান সমাজে প্রায় ৯৫% মুসলিমরা (এখানে বড় বড় আলেমরাও এবং সাধারণরাও) বিশ্বাস করেন বা মনে করেন যে, “ইমাম মাহাদীর জামানাতেই হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে অবতরন করবেন”। আসলে তাদের এই ধারণাটি যে সম্পূর্ণই ভুল তা হাদিসগুলো সঠিকভাবে যাচাই করলেই বুঝা যায়।
বিভিন্ন আলেম ও সাধারণ মুসলিমরা যাদের শেষ জামানা নিয়ে কিছু জ্ঞান আছে তারা সকলেই বিশ্বাস করেন ইমাম মাহদী এর আগমন হবে, ঈসা (আঃ) এর আগমন হবে। শেষ জামানার ফিতনা প্রসঙ্গে বহু হাদিস রয়েছে। এবং এ বিষয়ে ইমামদেরও মত রয়েছে। কিন্তু সমাজে প্রচলিত যে ইমাম মাহদী ও ঈসা (আঃ) একই যুগে আসবেন বা ইমাম মাহদী এর পিছনে ঈসা (আঃ) নামায পড়বেন। আলেমরাও এর পক্ষে হাদিসগুলি পেশ করে থাকেন, কিন্তু কোন হাদিসেই এটি বলে না যে, ইমাম মাহদী এর পিছনে ঈসা (আঃ) নামায পড়বেন বা তারা দুজনে একই যুগে আসবেন। এটি প্রচলিত হয়ে যাওয়ার দরুন ঢালাও ভাবে সকল মুসলিমরাই এখন এই বিষয়টিই সঠিক মনে করে। তবে হাদিসে সরাসরি বলা রয়েছে যে ঈসা (আঃ) কার পিছনে নামায পড়বেন ও ইমাম মাহদীর পর আরো যারা খলীফা হবেন তাদের পরিচয়। কিন্তু তারপরও তারা না জানার ফলে যে হাদিসগুলি পেশ করে থাকে তাতে আমীর এর পিছনে নামায পড়বেন বলে উল্লেখ থাকে আর সেই আমীরকে ইমাম মাহদী মনে করে থাকেন। ৩.৫ নং পরিচ্ছেদে এই বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। সেটিই হয়তো এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট কিন্তু এরপরও যদি কোন বিভ্রান্তি থাকে তাহলে এখানে তার আরো কিছু বিশ্লেষণ যোগ করা হলো-
কেন তারা এরকম ধারণা করছেন?
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "সেদিন কেমন হবে, যখন মরিয়মের পুত্র হযরত ঈসা (আঃ) তোমাদের মাঝে অবতরণ করবেন এবং তোমাদেরই একজন তোমাদের ইমাম হবেন"? (সহীহ, সহীহ মুসলিম ইসঃ ফাঃ ২৮৯ [হাঃ একাঃ ২৮৩; ইসঃ সেঃ ৩০০])
উল্লিখিত এই হাদিসে কোথাও ইমাম মাহদীর কথা উল্লেখ করা হয়নি, বরং এখানে স্পষ্ট করে “তোমাদের ইমামের” কথা বলা হয়েছে।
হযরত জাবের (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "আমার উম্মতের একদল মুজাহিদ কিয়ামত পর্যন্ত শত্রুর উপর বিজয়ী থাকবে। একপর্যায়ে আকাশ থেকে ঈসা ইবনে মারিয়ম (আঃ) অবতরণ করলে মুসলমানদের আমীর/সেনাপতি বলবে- আসুন, নামাজের ইমামতি করুন! তখন ঈসা (আঃ) বলবেন- না, বরং তোমাদের একজন অপরজনের নেতা (তুমি ইমামতি কর)। এটি এই উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিরাট সম্মান"।
- (সহীহ মুসলিম ইসঃ ফাঃ ২৯২ [হাঃ একাঃ ২৮৬; ইসঃ সেঃ ৩০৩]; মুসনাদে আহমাদ)
এই হাদিসেও ইমাম মাহদীর কথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে, "তোমাদের একজন অন্যজনের আমীর"। তার আগে বলা হয়েছে মুসলমানদের সেনাপতি আর এটা সাধারণ বিষয় যে ইমাম মাহদী খলীফা হবেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদুরী (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "ঈসা ইবনে মারিয়ম (আঃ) যার পিছনে নামাজ পড়বেন, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই একজন"।
- (সহীহ, কিতাব আল মাহদী, লেখকঃ হাফিজ আবু নাঈম (রহ:); ফাইয়াদ আল কাদির, লেখকঃ আল মানাওয়ী)
এই হাদিসেও কোথাও ইমাম মাহদীর কথা উল্লেখ করা হয়নি, বরং এখানেও “তোমাদের একজনের” কথা বলা হয়েছে।
হযরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা:) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি, “হযরত ঈসা (আ.) আছরের নামাযের সময় অবতরণ করবেন। তখন মুসলমানদের আমীর তাঁর নিকট আবেদন জানাবেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি নামাজের ইমামতি করুন। তিনি বলবেন, এ উম্মত একে অন্যের উপর আমীর (অর্থাৎ তোমাদের জন্যই নামাজের ইকামত দেওয়া হয়েছে, তাই তোমরাই নামাজ পড়াও) তখন আমীর অগ্রসর হয়ে নামায পড়াবেন।”
- (মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, ২১৬ পৃষ্ঠা; দুররে মানসুর, ২য় খণ্ড, ২৪৩ পৃষ্ঠা; মুসতাদরাকে হাকিম, ৪র্থ খণ্ড, ৪৭৮ পৃষ্ঠা)
এই হাদিসেও ইমাম মাহদীর কথা কোথাও বলা নেই, বরং বলা হয়েছে "মুসলমানদের আমীরের" কথা। মূলত এই কতক হাদিস ছাড়া আর কোন দলিলই নেই যা দিয়ে প্রমাণ করতে পারে যে ইমাম মাহদীর জামানায় ঈসা (আঃ) এর আগমন হবে। আর এই দলিলগুলো দিয়েও সরাসরি প্রমাণ হয় না যে, ইমাম মাহদীর পিছনে ঈসা (আঃ) নামাজ পড়বেন। তাহলে কার পিছনে পড়বেন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ৩.৫ নং পরিচ্ছেদে দেওয়া হয়েছে।
তাই বেশিরভাগ আবেগী মুসলমান মনে করেছেন, এসকল হাদিসগুলোতে মুসলমানদের ইমাম বা আমীর বলতে ইমাম মাহদীর কথা বলা হয়েছে। যদিও এই ধারণাটি একদমই ঠিক নয়। ইমাম মাহদী ছাড়াও আরো অনেক আমীর বা খলীফা হবেন তা হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট। রসূলুল্লাহ ﷺ এর এমন কোন সহীহ, হাসান হাদিসেও সরাসরি বলা হয়নি যে, হযরত ঈসা (আঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল মাহদী একই সময়ে আত্নপ্রকাশ করবেন। বরং অসংখ্য হাদিস রয়েছে এই মতের বিপরীত, যে হাদিসগুলো নিয়ে গবেষণা করলে বুঝা যায়, হযরত ইমাম মাহদী ও ঈসা (আঃ) এর আবির্ভাবের মধ্যে রয়েছে বিশাল একটা সময়ের ব্যবধান।
ইমাম মাহদী ও হযরত ঈসা আঃ একই সময়ে আবির্ভাব হবেনা, তার প্রমাণ সমূহ
সহীহ হাদিসে এসেছে ইমাম মাহদী সাত থেকে নয় বছর জীবিত থাকবেন আর তার খিলাফতের সময়ও এটাই, তার জামানায় পৃথিবীতে শান্তি, শৃঙ্খলা বিরাজ করবে।
আবু সাঈদ খুদরী (রা:) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন, আখেরী যামানায় আমার উম্মাতের ভিতরে মাহদীর আগমণ ঘটবে। তাঁর শাসনকালে আকাশ থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, যমিন প্রচুর ফসল উৎপন্ন করবে, তিনি মানুষের মাঝে সমানভাবে প্রচুর সম্পদ বিতরণ করবেন, গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর সম্মান বৃদ্ধি (হারানো গৌরব ফিরে) পাবে। তিনি সাত বছর কিংবা আট বছর জীবিত থাকবেন।
- (মুস্তাদরাকে হাকিম ৪/৬০১; সিলসিলায়ে সহীহা ৭১১; আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন)
উপরের হাদিসটি আমরা মনে রাখবো, এখন কিছু সময়ের জন্য ধরা যাক ইমাম মাহদীর জামানাতেই ঈসা (আঃ) আগমন করবেন। এখন ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে আগমনের কারণ হবে দাজ্জালের প্রকাশ হওয়ার পরে। কারণ এর আগে তো ঈসা (আঃ) এর আগমন হবে না যা অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। দাজ্জাল প্রকাশ পাওয়ার পর চল্লিশ দিন পৃথিবীতে ফিতনা করবে। এই চল্লিশ দিনের ব্যাখ্যায় এসেছে প্রথম দিন ১ বছরের সমান, পরের দিন ১ মাস, তার পরের দিন ১ সপ্তাহ, আর বাকি দিন সাধারণ দিনের মত। এখন এই সময়টি যদি যোগ করা হয় তা ১ বছর ও ২ মাসের কম-বেশি সময়। এই সময়ের আগে ঈসা (আঃ) আসবেন না। এখন এই সময়ে দাজ্জাল পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি করতে থাকবে। তাও ইমাম মাহদী খলীফা থাকা অবস্থায়! তাহলে ইমাম মাহদীর যুগ কিভাবে শান্তিময় হলো আর উম্মতে মুহাম্মাদী কিভাবে সুশৃঙ্খল থাকলো? শুধু এই একটি ফিতনা নয়, আরো রয়েছে যুদ্ধ বিগ্রহও। হাদিসে এসেছে-
হযরত উম্মে শুরাইক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল ﷺ কে আমি বলতে শুনেছি, দাজ্জালের ভয়ে পলায়ন করে মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিবে। উম্মে শুরাইক রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রসূল! আরব সম্প্রদায় তখন কোথায় থাকবে? উত্তরে রসূল ﷺ বললেন, আরব সম্প্রদায় তখন সংখ্যায় অল্প থাকবে।
- (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭২৮৩-(১২৫/২৯৪৫) [ইঃ ফাঃ ৭১২৬, ইঃ সেঃ ৭১৭৯]; সুনান তিরমিযী ৩৯৩০; রিয়াযুস স্বা-লিহীন তাঃ পাঃ ৬/১৮২২ [আন্তঃ ১৮১৩]; মুসনাদে আহমাদ ৬/৪৬২, হাঃ ২৭০৭৩)
দেখা যাচ্ছে তাহলে ইমাম মাহদী জীবিত থাকা অবস্থাতেই ফিতনা দেখা দিয়েছে। যা প্রথম সেই সহীহ হাদিসটির বিপরীত। এখানেই শেষ নয়। হাদিসে এসেছে দাজ্জাল রেগে বের হয়ে আসবে আর এর কারণ হচ্ছে মুসলিমরা বিভিন্ন যুদ্ধে বিজয়ী হতে থাকবে। এখন দাজ্জাল প্রকাশ হওয়ার আগের অন্যতম কারণ হবে মুসলিমদের কুসতুনতুনিয়া বিজয়। হাদিসে এসেছে-
মাকহুল বলেছেন- মালহামা বা মহাযুদ্ধ, কুসতুনতুনিয়া বিজয় আর দাজ্জালের বের হওয়ার মাঝে সাত মাস সময়। চুক্তি হওয়া আর ভঙ্গ হওয়া (রোমদের সাথে) মাঝেও একই সময়। একটা আরেকটার পর পর হবে।
- (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা ৩৬৫০৭)
হযরত যুবায়ের ইবনে নুফাইর (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি এরশাদ করেন, মুসলমানগণ, আল্লাহু আকবর তাকবীর দ্বারা কাফেরদের একটি শহর দখল করবে, উক্ত শহরের তিনটি দেয়াল আল্লাহ তাআলা তিন দিনে ধ্বংস করে দিবেন। এভাবে যুদ্ধ চলাকালীন তাদের কাছে দাজ্জালের অবির্ভাব হওয়ার খবর এসে পৌঁছবে। উক্ত খবর যেন তোমাদের মাঝে কোনো আতঙ্ক বিরাজ না করে, কেননা সংবাদটি মিথ্যা হবে। সুতরাং উল্লিখিত খবর শুনে দৌড় না দিয়ে গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে থাকবে।
- (আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১৩৯৩ [পথিক প্রকা: ১৩৯২; তাহকীক: যঈফ])
হযরত কা’ব (রা:) হতে বর্ণিত যে, রসূল ﷺ বলেন তাদের নিকট এ খবর পৌছেছে যে, তাদের কুস্তুনতুনিয়া বিজয়ের পর দাজ্জালের অবির্ভাব ঘটবে। অতঃপর তাঁরা ফিরে যাবে এবং কিছু পাবে না। অতঃপর কিছুদিন অবস্থান করবে এরই মধ্যে দাজ্জাল বের হবে।
- (আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১৪৬৯ [পথিক প্রকা: ১৪৬৭; তাহকীক: যঈফ])
হযরত সাফ্ওয়ান ইবনে আমর জনৈক সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে রেওয়ায়েত করেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেন, আমার উম্মতের একদল ভারতের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিজয়ী করবেন। এক পর্যায়ে শিকল পরা অবস্থায় ভারতের রাজার সাথে মুসলমানদের স্বাক্ষাৎ হবে। এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের প্রত্যেক যাবতীয় অপরাধ আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিবেন। অতঃপর তারা শাম নগরীর দিকে অগ্রসর হবে এবং সেখানেই তারা সায়্যিদুনা হযরত ঈসা (আঃ) কে পেয়ে যাবে।
- (আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১২০২ [পথিক প্রকা: ১১৯৯; তাহকীক: যঈফ])
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত কা’ব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বায়তুল মোকাদ্দাসের জনৈক বাদশাহ (জাহজাহ) ভারতের দিকে সৈন্য প্রেরণ করে ভারত জয় করবেন এবং সেখানে অবস্থিত যাবতীয় সম্পদসমূহ হস্তগত করার পর সেগুলোকে বায়তুল মোকাদ্দাসের অলংকার হিসেবে রেখে দিবেন। এরপর ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্র জয় করার পর দাজ্জালের আবির্ভাব হওয়া পর্যন্ত তারা ভারতেই অবস্থান করতে থাকবে।
- (আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১২১৫ [পথিক প্রকা: ১২১২, যঈফ জিদ্দান])
উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে এটি বুঝা যাচ্ছে যে দাজ্জাল প্রকাশ হওয়ার আগে মুসলিমরা যুদ্ধরত অবস্থায় থাকবে। তারা একাধারে কুসতুনতুনিয়া বিজয় করবে, এরপর আরেকটি শহর শুধু তাকবীর দিয়ে ধ্বংস করবে এবং রোমদের সাথে মহাযুদ্ধ করবে। এই সকল যুদ্ধের কারণ হবে নতুন করে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির কারণে আর এতে রোমরা চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং বিশৃঙ্খলা করবে, আর ইহুদিরাও চুক্তি ভঙ্গ করবে, বিশৃঙ্খলা করবে ও হিন্দুস্তানের দ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ যুদ্ধটিও হবে। মানে এত এত যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া ও বিজয় হওয়া এরপরই দাজ্জালের আগমনের ফিতনা যা উল্লিখিত হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তাহলে এই সকল কিছু কি ইমাম মাহদীর খিলাফতকালে সংঘটিত হবে যেখানে বলা হয়েছে তার জামানাতে কোন ফিতনা-বিশৃঙ্খলা হবে না? এখানেও হাদিসের বিপরীত বিষয় পরিলক্ষিত হয়। আবার দাজ্জালের আগমনের আগে এই সকল যুদ্ধ হবে যেরকম বলা রয়েছে তেমনি বলা রয়েছে এই যুদ্ধগুলো কার মাধ্যমে হবে আর তখন কে খলীফা থাকবেন। শুধু তাই নয় দাজ্জালের আগমনের আগে আবার পৃথিবীতে অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে।
আসমা বিনতে ইয়াযিদ আনসারিয়া (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর ঘরে অবস্থান করছিলাম। তখন তিনি দাজ্জাল বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, দাজ্জালের আবির্ভাবের পূর্বে তিনটি বৎসর এমন হবে যে, প্রথম বৎসর আকাশ তার এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবে। ভূমি তার এক তৃতীয়াংশ ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দিবে। দ্বিতীয় বৎসর আকাশ তার দুই তৃতীয়াংশ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবে। ভূমি তার দুই তৃতীয়াংশ ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দিবে। তৃতীয় বৎসর আকাশ তার পরিপূর্ণ বৃষ্টি বন্ধ করে দিবে। পাশাপাশি ভূমিও তার ফসল উৎপাদন পরিপূর্ণরূপে বন্ধ করে দিবে। ফলে সুস্থ ও অসুস্থ সকল গরু ছাগল ও প্রাণীর প্রাণহানি ঘটবে।
- (সুনানে ইবনে মাজাহ ৪০৭৭; মুসনাদে আহমদ ২৭৫৬৮; আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১৪৮১; একই রকম বর্ণনা সূত্রে)
তাহলে দাজ্জাল যদি ইমাম মাহদীর জামানাতেই আবির্ভাব হয় তাহলে দাজ্জাল হত্যা হওয়ার আগে ১ বছর ২ মাস পৃথিবীতে ঘুরবে। আর দাজ্জাল বের হওয়ার আগে ৩ বছর বৃষ্টি কমে যাবে, ফসল হবে না ঠিক মত। আর এর আগে সংঘটিত হবে রোমদের সাথে মহাযুদ্ধ, কুসতুনতুনিয়ার যুদ্ধ, হিন্দুস্তানের যুদ্ধ। তাহলে এতকিছু যদি ইমাম মাহদীর খিলাফত কালেই সংঘটিত হয়, তাহলে তার খিলাফত কালে শান্তি বা শৃঙ্খলা থাকলো কোথায়? তার জামানাতে তো যুদ্ধ-বিগ্রহ, ফিতনা-বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাহলে পৃথিবী শান্তিময় কবে কখন হবে? সহীহ হাদিসে রয়েছে যে, তার জামানাতে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করবে ও সব কিছুতে বরকত থাকেবে। এখন তাহলে এই সকল ফিতনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মালহামা কখন হবে? নাকি হবে না? তাহলে এইগুলো তার জামানায় বা তার খিলাফতকালে না হলে কখন হবে? হাদিসে এসেছে-
হযরত দীনার ইবনে দীনার (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি এরশাদ করেন, আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, নিঃসন্দেহে মাহদি মৃত্যুবরণ করলে মানুষের মাঝে ব্যাপক গণহত্যা দেখা দিবে এবং একে অন্যকে হত্যা করবে। অনারবদের জয়জয়কার হবে এবং ভয়াবহ যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রকাশ পাবে। মানুষের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা এবং একতাবদ্ধতা থাকবেনা, এক পর্যায়ে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।
- (আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১১৩৪ [পথিক প্রকা: ১১৩১; তাহকীক: যঈফ])
হযরত কাতাদাহ (রা:) বলেন, রসূল ﷺ বলেছেন, শেষ জামানায় ইমাম মাহদীর আগমন ঘটবে, তখন তিনি দুই হাতে মানুষের মাঝে শান্তি বন্টন করবে। তারপর (মাহদীর মৃত্যুর পরে) আবার ফিতনা দেখা দিবে, তখন আসবে মরিয়ম এর পুত্র ঈসা (আঃ)।
- (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ৮১২)
এগুলোই যথেষ্ট এটা প্রমাণ করতে যে, ইমাম মাহদীর পিছনে ঈসা (আঃ) ছলাত আদায় করবেন না আর না ইমাম মাহদীর জামানায় ঈসা (আঃ) আগমন করবেন। হাদিসে এখানে স্পষ্টভাবে এসেছে যে ইমাম মাহদীর মৃত্যুর পরই সকল ফিতনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা দিবে আর তার শেষ পর্যায়ে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। হাদিস থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে ইমাম মাহদীর মৃত্যুর পরই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। হয়তো অনেকে এটাও বলতে পারেন যে এই সকল যুদ্ধ অন্য কোন সময় হবে বা মাহদীর আগে হবে বা দাজ্জালকে হত্যার পরে হবে। তারা হয়তো আরেকটি হাদিসকে আবারো মিথ্যারোপ করছে-
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা:) হতে বর্ণিত, রসূল ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বদা একটি দল থাকবে যারা হকের পক্ষে যুদ্ধ করবে, তারা দুশমনদের উপর বিজয় থাকবে, তাদের সর্বশেষ দলটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
- (সহীহুল মুসলিম ২৯২, ৪৭১৭; সুনান আবু দাউদ ২৪৮৪; আস সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ৭৫১, ১১৬৭; মুসনাদে আহমদ ১৯৮৯৫; মুসতাদরাকে হাকিম ৩/৪৫০)
অর্থাৎ দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ হওয়ার পর আর কোন যুদ্ধ নেই যা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত একটি বিষয়। আর দাজ্জালের সাথে যুদ্ধই মুসলিম উম্মাতের শেষ যুদ্ধ, এর পরে আর কোন জিহাদ-কিতাল নেই। এরকম আরো অসংখ্য হাদিস থেকে প্রমাণ হয় যে, ইমাম মাহদীর পিছনে ঈসা (আঃ) এর ছলাত আদায় তো দূরে থাক তাদের কোন দেখা-সাক্ষাৎই হবে না, তারা একই যুগেই আসবেন না। তাদের দুজনের মধ্যে অনেক বছরের ব্যবধান রয়েছে। কারণ ইমাম মাহদী খিলাফতের দায়িত্ব সাত থেকে নয় বছর পালন করার পরে মৃত্যুবরণ করবেন এবং তারপরেও আরো অনেকে খলীফা হবেন। হাদিসে এসেছে-
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে কাইস ইবনে জাবের সাদাফী (রা:) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন, কাহতানী এবং পরবর্তীতে আরো যারা খলীফা ও আমীর নিযুক্ত হবেন, তারা প্রত্যেকে মাহদীর পর আসবেন।
- (আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ১২০৯ [পথিক প্রকা: ১২০৬; তাহকীক: যঈফ])
হযরত কা'ব (রা:) বলেন, আমি রসূল ﷺ কে বলতে শুনেছি অচিরেই মুসলমানরা এক দুর্বল বালকের নেতৃত্বে হিন্দুস্তান দখল করবে। আর এ যুদ্ধের ব্যপারেই তোমাদের প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। আর আল্লাহও এই যুদ্ধে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর সেখান থেকেই আল্লাহ মুশরিকদের পতন করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। একথা বলে তিনি সুরা ইব্রাহিম এর ৪৭ নং আয়াত পাঠ করলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলঃ হে আল্লহর রসূল ﷺ! তাহলে মানুষ দাজ্জালকে দেখবে কখন? তিনি বললেন, যখন জাহজাহ পৃথিবী শাসন করবে তখন হিন্দুস্তান আবারও ইহুদীদের দখলে যাবে। আর তখন বায়তুল মুকাদ্দিস মুসলমানরা শাসন করবে। আর সেখান থেকে জাহজাহ কালোপতাকা নিয়ে এক দল সৈন্য হিন্দুস্তানে পাঠাবেন এবং হিন্দুস্তান দখল করবে। তারা সেখানে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) এর আগমন পর্যন্ত অবস্থান করবে। আর আল্লাহর নবী ঈসা (আ.) ৩৩ বছর পৃথিবী শাসন করবেন।
- (আস-সুনানু কিতাবুল ফিরদাউস ১৫০৭; কিতাবুল আক্বিব ১০০; আখীরুজ্জামানা আল মাহদী ফিল আলামাতিল কিয়ামাহ ২৩৫)
এই সকল হাদিস জানার পর এই বিষয়ে আর কোন মতবিরোধ থাকার কথা নয়। যারা বলছেন যে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হবে আর ইমাম মাহদীর ইমামতিতে ঈসা (আঃ) ছলাত আদায় করবেন তাদের কাছে এর কোন সঠিক দলিল নেই। এটি একটি বানোয়াট উক্তি যা শুধু ধারণা ভিত্তিক হয়েছে যা অসংখ্য হাদিসের বিপরীত বৈ কিছুই নয়।
0 মন্তব্যসমূহ