আবূ হুরাইরাহ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি আল্লাহর রসূল ﷺ থেকে দু’পাত্র ‘ইলম আয়ত্ত করে রেখেছিলাম। তার একটি পাত্র আমি বিতরণ করে দিয়েছি। আর অপরটি এমন যে, প্রকাশ করলে আমার কণ্ঠনালী কেটে দেয়া হবে। ‘আবদুল্লাহ্ (রহ.) বলেন, হাদীসে উল্লিখিত الْبُلْعُومُ শব্দের অর্থ খাদ্যনালী।
- (সহীহ, সহীহুল বুখারী তাঃ পাঃ ১২০ [আঃ প্রঃ ১১৮; ইসঃ ফাঃ ১২২]; মিশকাত ২৭১)
আবু হুরাইরাহ এমন আর কি জ্ঞান নবীজির থেকে পেয়েছিলেন যা তিনি প্রকাশ করেন নি বা প্রকাশ করতে ভয় পেতেন? তিনি শরীয়তের জ্ঞান ছাড়াও আরো দুই ধরণের জ্ঞান জানতেন যার মধ্যে একটি তাসাউফের জ্ঞান ও আরেকটি ফিতনা সংক্রান্ত জ্ঞান। দ্বিতীয় সেই জ্ঞানই হচ্ছে সেই ফিতনা সম্পর্কিত জ্ঞান যা হাদিস শাস্ত্রে খুব কমই বর্ণিত হয়েছে আর যেগুলো বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলোর বেশির ভাগই জঈফ বা হাসান। এই হাদিসগুলোর সঠিক সনদ বা বর্ণনা ঠিক না থাকার কারণে তা অনেক সময় মুনকার-অতি দুর্বল হিসেবেও চিহ্নিত হয়। তবে সেগুলোর বর্ণনা বেশির ভাগই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কারণ ইসলামে কিছু বিষয় যা গায়েবের অন্তর্ভুক্ত তা ছাড়া আর সব কিছুই প্রকাশ করা হয়েছে। আর গায়েবের বিষয় গুলো কোনগুলো তা ইলহামী ভবিষ্যৎবাণী অধ্যায়ে আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। সে সম্পর্কে হাদিস-
হুযাইফাহ (রা:) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে সেসবের বর্ণনা দিলেন। কেউ তা মনে রাখলো এবং কেউ তা ভুলে গেলো। আমার এসব সাথী তা অবহিত আছে যে, ঐ সবের কিছু ঘটলেই আমি তা এরূপ স্মরণ করতে পারি যেরূপ কেউ তার পরিচিত লোকের অনুপস্থিতিতে তার চেহারা স্মরণ রাখে। অতঃপর তাকে দেখা মাত্র চিনে ফেলে।
- (সুনান আবূ দাউদ ৪২৪০; বুখারী; মুসলিম)
হযরত হুযাইফা (রা:) বলেছেন, আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আল্লাহর রসূল ﷺ এমন একটা ফিতনাও বর্ণনা করতে বাদ রাখেননি যেগুলো পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত হবে এবং তার নেতৃত্বদানকারীর সংখ্যা তিনশো বা আরো বেশী হবে। নাবীজি ﷺ প্রতি ফিতনার আলোচনাকালে তার নেতার নাম, নেতার পিতার নাম, গোত্রের নাম উল্লেখ করেছেন।
- (সুনানে আবূ দাউদ; ৩য় বিশ্বযুদ্ধ, মাহদী ও দাজ্জাল -আসেম ওমর পৃঃ ৩৯৬)
হুযাইফা (রা:) বলেন, আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমি জানিনা আমার এই বন্ধুরা ভুলে গেছে নাকি স্মরণ থাকা সত্ত্বেও ভুলে যাওয়ার ভান ধরে আছে। আল্লাহর কসম আল্লাহর রসূল ﷺ কেয়ামত পর্যন্ত জন্মলাভ করবে এমন একজন নৈরাজ সৃষ্টিকারীর নাম উল্লেখ করতে বাদ রাখেন নি। তিনি ﷺ প্রতিজন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীর কথা উল্লেখ করার সময় আমাদেরকে তার নিজের নাম, তার পিতার নাম ও তার গোত্রের নাম বলে দিয়েছেন।
- (যঈফ, সুনান আবূ দাউদ ৪২৪১; মিশকাত ৫৩৯৩; আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ৩)
হযরত হুজাইফা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর কসম শহরের রাস্তাগুলো থেকে এমন কোনো রাস্তা কিংবা গ্রামের গলিসমূহ থেকে এমন কোনো গলি নেই যার সম্বন্ধে আমি জানিনা যে, হযরত ওসমান (রা:) কে শহীদ করার পর যাবতীয় ফিতনা ফাসাদ প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ, সবকিছু আমার কাছে পূর্ব থেকে জানা আছে।
- (সহীহ, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ ২৭; কিতাবুল ফিতান মিন কিসমিল আফআল ৩১৩১০)
আলী রা: বলেছেন: ইসলাম কমে যেতে থাকবে। এমন কি "আল্লাহ, আল্লাহ" বলার মত মানুষ থাকবে না। এ অবস্থা হলে দ্বীনের এক শীর্ষ নেতা দাঁড়িয়ে যাবে তার পাপ নিয়ে। এর পর মানুষ বেরিয়ে তার চারিদিকে জড়ো হত থাকবে যেভাবে শরৎ কালে মেঘ জমা হয়। ওয়াল্লাহ! আমি তাদের আমীরের নাম জানি এবং তাদের ঘোড়ার জাতও জানি।
- (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা ৩৬৪৫৪)
এরকম ভাবে আমাদের নাবী ﷺ তিনি সব কিছুই বলে গিয়েছেন, যা সাহাবীরা জানতেন। এই সকল হাদিস যুগের পরিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করার কারণে। এরকম হাজারো কিতাবে হাজারো হাদিস উল্লেখ রয়েছে যাতে শুধু এই বিষয়টিই উল্লেখ আছে যে সাহাবীরা ভবিষ্যতের অনেক ঘটনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। যারা এই সম্পর্কে জেনেছেন তারাও এগুলো বর্ণনা করতে ভয় করতো। তারা এগুলো বর্ণনা তেমন করেন নি, কিছু রেওয়ায়েতে এরকম এসেছে যে সেগুলো বর্ণনা করার দরুন মৃত্যুও হতে পারে। যেমন হাদিসেই এসেছে এ ব্যাপারে-
হুজাইফা (রা:) বলেছেন, আমার ইচ্ছে হয় আমার সাথে ১০০ জন লোক থাকবে যাদের অন্তর হবে স্বর্ণের। এর পর আমি একটা পাথরের উপর উঠে তাদেরকে হাদিস বর্ণনা করবো যে এরপর তারা আর কখনো ফিতনায় পড়বে না। এরপর অল্প অল্প করে আমি চলে যাবো। আমি আর তাদের দেখবো না, তারাও আমাকে দেখবে না।
- (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা ৩৬৪৫৭; আল-ফিতান)
হুজাইফা (রা:) বলেছেন, আমি যদি তোমাদের বলি যা আমি জানি, তবে তোমরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। এক ভাগ আমাকে কতল করবে। এক ভাগ আমাকে কোনো সাহায্য করবে না। আর এক ভাগ আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে।
- (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা ৩৬৪৭০)
মুফতি কাজী ইবরাহীম, যিনি শেষ জামানা সম্পর্কে বাংলাদেশে একজন গবেষক হিসেবে পরিচিত তার বক্তব্যে বলেন (হুবহু নকল)- “কেয়ামত বিষয়ক হাদিস দুর্বল হবে এটাই নিয়ম। এগুলি সবল হবে না, সহীহ হবে না এটাই নিয়ম। হুকুম-আহকাম বিষয়ক, নামাজ-রোজা, হজ-যাকাত বিষয়ক হাদিস সহীহ হইতে হবে এটা নিয়ম। আর কেয়ামতের সংবাদ, কোন রাজা কেমন, তার সৈন্যবাহিনী কেমন, সে কি করবে এই সংক্রান্ত হাদিসগুলি দুর্বল হওয়াই নিয়ম। দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। এখানে সহীহ খোঁজা বোকামি। যারা সহীহ খুঁজে তারা হাদিসের প্রাথমিক ছাত্র। হাদিসের চূড়ান্ত ক্লাসের ছাত্র তারা হতে পারে নাই। কারণ কি, এই হাদিসগুলি যারা বর্ণনা করেছেন সাহাবায়ে কেরাম তাদের মধ্যে শীর্ষ একজন সাহাবী আবু হুরাইরা রাঃ। উনি বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল ﷺ থেকে দু’পাত্র ‘ইলম আয়ত্ত করে রেখেছিলাম। তার একটি পাত্র আমি বিতরণ করে দিয়েছি। আর অপরটি এমন যে, প্রকাশ করলে আমার কণ্ঠনালী কেটে দেয়া হবে’। নামাজের বিধানগুলি, যাকাত, সিয়াম, হজ-ওমরা, ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক, মু’আমালাত, আকাইদ এই বিষয়ের হাদিসগুলি তোমাদের সব দিয়ে দিয়েছি, একটি হাদিসও আমি না বলে যাইনি। আমার কাছে আরেক ব্যাগ হাদিস আছে, আমি যদি এগুলি ছড়িয়ে দেই, সবার কাছে বলতে যাই, আমার এই গলা কেটে দেওয়া হবে। এজন্য এই হাদিস সবার সম্মুখে আবু হুরাইরা (রা:) কখনো বলেন নাই। দু এক জনের কাছে বলে গেছেন যারা খুব বিশ্বস্ত আর মৃত্যুর আগে দু তিন জনকে বলে গেছেন, এই। এজন্য হাজার হাজার, লাখ লাখ ছাত্ররা শুনলে না এক হাজার ছাত্রের মধ্যে একশ পাবো আমি সহীহ হাদিসের রাবী। ঠিক না? উনি বায়ানই করেছেন তিন-চার জনের কাছে, আমি সহীহ পাব কই। এখানে সহীহ পাওয়া, সহীহ খোঁজা বোকামি, জাহালত, এইসব হাদিস সম্বন্ধে অজ্ঞতা। এই হাদিসের যিনি বিশেষজ্ঞের বিশেষজ্ঞ ছিলেন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) যার ব্যাপারে বলা হয় দশ লক্ষাধিক হাদিস তার মুখস্ত ছিল, সেই ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলতেন, ‘তিনটা ইলম আছে এগুলোর কোন সনদ পাইবা না। ঐ তিন এলেমের হাদিসগুলির সনদ, সূত্র পাইবা না। কিন্তু ওইগুলি শুদ্ধ মানতে হবে। তাফসীর, আল আশরাত, আল মালাহিম। কুরআনের তাফসিরের রেওয়ায়েত সব সহীহ পাওয়া যায় না। কারণ কুরআন নিজেই তো আছে। এখানে রেওয়ায়েত না পাইলেও তেমন সমস্যা নেই। কুরআন একাই একশ। দ্বিতীয় হলো কেয়ামতের আলামত আর তৃতীয় হলো শেষ জামানার যে মহাযুদ্ধগুলি হবে এগুলির সহীহ সনদ পাওয়া যায় না। ভয়ে এগুলি কেউ বলে নাই। যে বলছে, তারে বন্দী করছে, ফাঁসি দিসে, তারে দেশান্তরিত করছে। আমি যদি এখন বাংলাদেশে বসে কিছু হাদিস বলি যে, আমাদের অমুক নেতাদের নাম এই হাদিসে আছে, আমারে রাখবো আস্ত? যার ফলে আমি ডরে-ভয়ে কোনদিনও কারো নাম থাকলেও বলতাম না। খামাখা আমার মরার দরকার আছে!”
হাদিস থেকে সহজেই এই বিষয়টি প্রমাণ হয় যে, কিছু হাদিস বা রসূল ﷺ থেকে পাওয়া এক ধরনের জ্ঞান সাহাবীরাও তেমন বর্ণনা করতেন না, তবে সেগুলো যে হুকুম-আহকাম সম্পর্কিত নয় তা তাদের হাদিসগুলো থেকেই বুঝা যায়। আর কেন বর্ণনা করতেন না তার কারণগুলোও হাদিসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এই সকল ফিতনা, মালহামার হাদিসগুলো সরাসরি রসূল ﷺ থেকে বর্ণিত না হয়ে বেশির ভাগ সময়েই সাহাবী বা তাবীঈদের কাছ থেকে তাদের নিজের ভাষায়ই বর্ণিত হতে দেখা যায়, তাতে বর্ণনার তারতম্যও ঘটে। তাই বর্ণনার দিক দিয়েও এগুলি দুর্বল থেকে যায়। তেমনি সনদেও দুর্বল থেকে যায়। আর বর্ণনার বিভিন্ন তারতম্য এগুলোকে আরো দুর্বলভাবে উপস্থাপন করতে বাধ্য করে। তবে একই রকম বর্ণনা বেশি পাওয়া গেলে সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয় আর তা হাসান পর্যায়েরও কাছাকাছি চলে যায় যখন তার পক্ষে সহীহ রেওয়ায়েতও থাকে। কিন্তু এরপরও অনেকে ফিতনার হাদিসগুলো জঈফ বা দুর্বল বলে এড়িয়ে যায়, আর দেখা যাচ্ছে সেই বাণীগুলোই আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে, এতেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে সেগুলো সত্য আর যেগুলো হয় না তা ভুল বর্ণনা। যেমন একটি উদাহরণ- সুনান আন-নাসাঈর হিন্দুস্তানের যুদ্ধ নিয়ে তিনটি হাদিসের দুটিই দুর্বল সনদের কিন্তু একটি হাদিস সহীহ সনদে বর্ণিত হওয়ায় সকল আলেমগণ সেই দুইটি দুর্বল হাদিসকেও গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। তা দলিল হিসেবেও সহীহ এর পাশে স্থান দিচ্ছেন। যেমন স্থান দিয়েছেন মাওলানা আসেম ওমর তার মাহদী ও দাজ্জাল বইতে, আবু উমার আল মুহাজির তার নেদায়ে তাওহীদ বইতে ইত্যাদি। আমরা এই বইয়ে কোন হাদিসগুলো নিয়েছি, কোন মূলনীতি অনুসরণ করেছি তা নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ দেওয়া থাকবে একদম শেষে ইনশাআল্লাহ।
0 মন্তব্যসমূহ