আমাদের শেষ নবী ও রসূল ﷺ, তিনি অসংখ্য ভবিষ্যৎবাণী করেছেন শেষ জামানা সম্পর্কে ও শেষ জামানার ফিতনা, মালহামা এবং তৎসময়ের নেতাদের সম্পর্কে। তাকে কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিত হবে সকল ফিতনা দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ বর্ণিত ভবিষ্যৎবাণী সত্য হওয়ায় এটা নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে, পরবর্তী সকল ভবিষ্যৎবাণীও একটি একটি করে মিলে যাবে। এটিই একটি নিদর্শন যে ইসলামই সঠিক ধর্ম। শেষ জামানার বড় বড় আলামতগুলো শুরু হতে কিছু বছর মাত্র বাকি। এর মধ্যে পৃথিবীর তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ মারা যাওয়ার হাদিসের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। পৃথিবী থেকে সকল পাপাচার উঠে যাবে সেই প্রেক্ষাপট সহজেই অনুধাবন করা যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ পৃথিবীব্যাপী শুরু হতে যাচ্ছে। বড় যুদ্ধের প্রস্তুতিও চলছে। শেষ জামানার প্রেক্ষাপট ও যেসকল আলামত রয়েছে তার বাস্তবায়ন প্রমাণ করে যে পৃথিবী নতুন ভাবে আবার সৃজিত হবে যেমন ভাবে পানি দ্বারা ময়লা পরিষ্কার করা হয়। আর সেগুলোর বর্ণনাই আমরা এই বইতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমানে যে সকল ঘটনা ঘটছে ও আগে ঘটে গেছে তার সকল কিছুই হাদিসের কিতাবে অনেক স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের প্রধানদের ব্যাপারে, বিভিন্ন ফিরকা, দল ও দলনেতা সম্পর্কে, সকল ঘটিতব্য বিষয়গুলোই উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা:) উল্লেখ করে বলেন-
হারমালাহ ইবনু ইয়াহইয়া আত তুজীবী (রহঃ) ..... আবু ইদরীস খাওলানী (রহঃ) বলতেন, হুযাইফাহ ইবনু ইয়ামান (রা:) বলেন, আমার ও কিয়ামতের মধ্যবর্তী সময়ের মাঝে ঘটমান বিপদাপদ সম্পর্কে আমি সর্বাধিক জ্ঞাত। বস্তুতঃ বিষয়টি এমন নয় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ অন্যদের কাছে বর্ণনা না করে শুধুমাত্র আমার কাছেই এ ব্যাপারটি বর্ণনা করেছেন। তবে রসূলুল্লাহ ﷺ এর এক বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। এতে তিনি ফিতনার ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করছিলেন। আর এগুলোর তিনটি এমন, যা কোন কিছুকেই ছাড় দিবে না। এর কিছু সংখ্যক গ্রীষ্মের ঝঞা বায়ুর মতো। আবার কিছু সংখ্যক ছোট এবং কিছু সংখ্যক বড়। হুযাইফাহ্ (রা:) বলেন, উক্ত মাজলিসে উপস্থিত লোকেদের মধ্যে আমি ছাড়া প্রত্যেকেই এ দুনিয়া হতে চির বিদায় নিয়েছেন।
- (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭১৫৪-(২২/২৮৯১) [ইঃ ফাঃ ৬৯৯৮, ইঃ সেঃ ৭০৫৫])
উসমান ইবনু আবু শাইবাহ ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) ..... হুযাইফাহ্ (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সকল বিষয় ফিতনার কথা বর্ণনা করলেন। তারপর যে স্মরণ রাখবার সে স্মরণ রাখল এবং যে ভুলে যাবার সে ভুলে গেল। তিনি বলেন, আমার এ সঙ্গীগণ জানেন যে, তন্মধ্যে কতক বিষয় এমন আছে, যা আমি ভুলে গেছি। কিন্তু সেটা সংঘটিত হতে দেখে আমার তা আবার মনে পড়ে যায়। যেরূপ কোন লোক দূরে চলে গেলে তার চেহারার কথা মানুষ ভুলে যায়। অতঃপর তাকে দেখে সে চিনে নেয়। *
- (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭১৫৫ [ইঃ ফাঃ ৬৯৯৯, ইঃ সেঃ ৭০৫৬])
- * এ হাদীস থেকে এ কথা বুঝার কোন সুযোগ নেই যে, নাবী মুহাম্মাদ ﷺ গায়েব জানতেন। বরং নাবী ﷺ কর্তৃক বর্ণিত শারীআতের প্রতিটি কথা ওয়াহীভিত্তিক এবং সে রকম একটি ওয়াহীভিত্তিক কথা যে, মানুষ কিয়ামাতের পূর্ব পর্যন্ত কি কি মুসীবাতের সম্মুখীন হবে সেটা তিনি ওয়াহীর মাধ্যমে আগেই জেনে উম্মাতকে জানিয়েছেন।
মুহাম্মাদ ইবনু বাশশার, আবু বকর ইবনু নাফি’ (রহঃ) ..... হুযাইফাহ (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত ঘটমান সমুদয় ফিতনা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে সংবাদ দিয়েছেন। ফিতনাহ সম্পর্কীয় কতক বিষয় সম্পর্কে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি। তবে মদীনাবাসীকে কোন কারণে মদীনাহ হতে বের করা হবে সে সম্পর্কে আমি তাকে প্রশ্ন করিনি।
- (সহীহ, সহীহুল মুসলিম হাঃ একাঃ ৭১৫৭ [ইঃ ফাঃ ৭০০১, ইঃ সেঃ ৭০৫৮])
হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামেন (রা:) বলেনঃ আল্লাহর কসম! আমি জানি না আমার সাথীরা ভুলে গেছেন না কি জেনে শুনে ভুলে আছেন। আল্লাহর কসম! কিয়ামত পর্যন্ত ফিতনার সংখ্যা হবে তিন শতাধিক। রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের প্রত্যেকের নাম, পিতার নাম ও গোত্রের নাম আমাদেরকে অবহিত করেছেন।
অন্যত্র আছে- (আল্লাহর শপথ করে বলছি, রসূলুল্লাহ ﷺ এমন কোন ফিতনাকারীর আলোচনা অবশিষ্ট রাখেননি, যা কিয়ামত পর্যন্ত আবির্ভূত হবে এবং তার সাথে উক্ত ফিতনাহ সৃষ্টিকারীদের সংখ্যা তিনশত বা তারও অধিক পর্যন্ত পৌছবে। বরং তিনি ঐ ব্যক্তির নাম, তার পিতার নাম এবং তার বংশ পরিচয়ও আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন।)
- (যঈফ, সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত/ আলবানী একাঃ) ৪২৪১ [ইঃ ফাঃ ৪১৯৩]; মিশকাত হাঃ একাঃ ৫৩৯৩) (অন্যান্য হাদিসের সাথে বিপরীত অর্থ না থাকায় গ্রহণযোগ্য।)
- কারণ সনদে ‘লাকবী’সহ মাজহুল, বলা হয়ে থাকে যে, তার নাম ইসহাক্ ইবনু কবীসাহ্ ইবনু যুআয়ব আল খুযা'ঈ আশ শামী, সত্যবাদী, সে মুরসাল হাদীস বর্ণনাকারী। আওনুল মা'বুদ ১১/২০৭ পৃ., হা, ৪২৪৩।
আবূ উমাইয়া আশ-শাবানী (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ সালাবা আল-খুশানী রাঃ-এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই আয়াত সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন, কোন আয়াত? আমি বললাম, এই আয়াত (অনুবাদঃ) “হে মুমিনগণ! আত্মসংশোধন করাই তোমাদের কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না” (সূরা মায়িদাহ, ১০৫)। তিনি বলেন, আমি এ আয়াত সম্পর্কে অধিক অবহিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছি। আমি এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছি।
তিনি বলেনঃ বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ নিষেধ করতে থাকো। শেষে এমন এক যুগ আসবে যখন তুমি লোকেদেরকে কৃপণতার আনুগত্য করতে, প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে, পার্থিব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে এবং প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অহংকার করতে দেখবে। আর তুমি এমনসব গর্হিত কাজ হতে দেখবে যা প্রতিহত করার সামর্থ্য তোমার থাকবে না। এরূপ পরিস্থিতিতে তুমি নিজেকে হেফাজত করো এবং সর্বসাধারণের চিন্তা ছেড়ে দাও। তোমাদের পরে আসবে কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষার যুগ। তখন ধৈর্যধারণ করাটা জ্বলন্ত অঙ্গার হাতের মুঠোয় রাখার মত কঠিন হবে। সে যুগে কেউ নেক আমল করলে তার সমকক্ষ পঞ্চাশ ব্যক্তির সওয়াব তাকে দান করা হবে।
- (যঈফ, সুনান ইবনু মাজাহ তাঃ পাঃ ১/৪০১৪; আবূ দাউদ ৪৩৪১; তিরমিযী ৩০৫৮; মিশকাত ৫১৪৪; সহীহাহ ৪৯৪)
- তাহকীক আলবানীঃ যঈফ। উক্ত হাদিসের রাবী উতবাহ বিন হাকীম সম্পর্কে আবু আহমাদ বিন আদী আল-জুরজানী বলেন, আমি আশা করি তার মাঝে কোন সমস্যা নেই। আবু বাকর আল-বায়হাকী বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য নয়। আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, তিনি কিছুটা দুর্বল ছিলেন। আহমাদ বিন শু'আয়ব আন-নাসায়ী বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য নয়, তিনি দুর্বল। ইবনু হাজার আল-আসকালানী বলেন, তিনি সত্যবাদী তবে হাদিস বর্ণনায় ভুল করেন। (বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে মিলে যাওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য)
আবূ উমাইয়া আশ-শাবানী (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ সালাবা আল-খুশানী (রা:) -এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই আয়াত সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন, কোন আয়াত? আমি বললাম, এই আয়াত (অনুবাদঃ) “হে মুমিনগণ! আত্মসংশোধন করাই তোমাদের কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না” (সূরা মায়িদাঃ ১০৫)। তিনি বলেন, আমি এ আয়াত সম্পর্কে অধিক অবহিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছি। আমি এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছি। আনাস ইবনে মালেক (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রসূল ﷺ! আমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা কখন ত্যাগ করবো? তিনি বলেনঃ যখন তোমাদের মাঝে সেইসব বিষয় প্রকাশ পাবে, যা তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতদের মাঝে প্রকাশ পেয়েছিলো। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের পূর্বেকার উম্মাতগণের যুগে কি কি বিষয় প্রকাশ পেয়েছিলো? তিনি বলেনঃ তোমাদের মধ্যকার নিকৃষ্ট তরুণদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে যাবে। বয়স্ক লোক অশ্লীল কার্যকলাপে লিপ্ত হবে এবং নিকৃষ্ট লোক জ্ঞানের অধিকারী হবে। রাবী যায়েদ (রা:) বলেন, নবী ﷺ এর বাণীঃ ‘নিকৃষ্ট ও নীচ ব্যক্তিরা জ্ঞানের অধিকারী হবে’ এর তাৎপর্য হলোঃ পাপাচারীরা জ্ঞানের বাহক হবে।
- (যঈফ, সুনান ইবনু মাজাহ তাঃ পাঃ ২/৪০১৫; আহমাদ ১২৫৩১)
- তাহকীক আলবানীঃ মাকহুলের আন আন সুত্রে বর্ণনার কারণে সানাদটি দুর্বল। উক্ত হাদিসের রাবী আল হায়সাম বিন হুমায়দ সম্পর্কে আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, আমি তার ভাল ছাড়া খারাপ কিছু জানি না। ইমাম নাসাঈ বলেন, কোন সমস্যা নেই। ইবনু হিব্বান তাকে সিকাহ বলেছেন। আবু মুসহির বলেন, তিনি দুর্বল ও কাদিরিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। (তাহযীবুল কামালঃ রাবী নং ৬৬৪৩, ৩০/৩৭০ নং পৃষ্ঠা)
মাকহুল (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার এক গ্রাম্য ব্যক্তি রসূল ﷺ কে জিজ্ঞাসা করল যে, কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? তখন রসূল ﷺ উত্তরে বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারীর থেকে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি বেশী জানে না। তবে তার আলামত হলো, বাজার নিকটবর্তী হওয়া, বৃষ্টি (অতি বৃষ্টি) হওয়া, শস্য উৎপাদন না হওয়া। গীবত-পরনিন্দা ছড়িয়ে পড়া। ভ্রষ্ট সন্তানদের প্রকাশ। সম্পদশালীকে সম্মান করা হবে। মসজিদে ফাসেক ব্যক্তিরা উচ্চ আওয়াজ করবে। সৎকাজকারীদের উপর অপকর্মকারীদের আধিপত্য প্রকাশ পাবে। অতএব, যে ব্যক্তি উক্ত যমানা পাবে, সে যেন তার দ্বীন নিয়ে নিভৃতে থাকে। আর সে যেন ঘরের মোটা চাদর হয়ে থাকে, অর্থাৎ ঘরে অবস্থান করে।
- (মুরসাল, আল ফিতান: নুয়াইম বিন হাম্মাদ, পথিক প্রকাঃ ১৮০০)
এই হাদিসগুলো যঈফ হলেও দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানে এর হুবহু মিল রয়েছে। এই সকল হাদিসে যেন বর্তমান জামানার চিত্র ভেসে উঠে।
0 মন্তব্যসমূহ