২.৩ ইলহাম সত্য এবং সহীহ দলিল দ্বারা প্রমাণিত

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তিনিই একমাত্র গায়েব জানেন। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের কোথাও এই কথা বলা নেই যে, তিনি গায়েবের বিষয়গুলো অন্য কাউকে জানাবেন না। তিনিই একমাত্র গায়েব জানেন এটি যেমন সত্য, তেমনি আল্লাহ তায়ালা গায়েবের অনেক বিষয় মাখলুককেও জানান, সেটিও সত্য। অর্থাৎ, গায়েবের বিষয়ে মাখলুকের কোন স্বাধীন জ্ঞান নেই। গায়েবের বিষয় সম্পর্কে জানার নিজস্ব কোন ক্ষমতা মাখলুকের নেই। কেউ যদি দাবি করে যে, সে চাইলেই গায়েবের যে কোন বিষয় সম্পর্কে জেনে নিতে পারে তাহলে তা হবে সুস্পষ্ট শিরক। এটি সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তিনি কাকে, কখন, কোথায় কোন গায়েব সম্পর্কে জানাবেন একমাত্র তিনিই ভালো জানেন আর গায়েবের বিষয়ে জানানোর পর সেই জ্ঞানটি আর গায়েবের জ্ঞান থাকে না, কারণ তা তো জানিয়েই দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলদেরকে ওহী পাঠানোর মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করতেন আর তাঁর অন্যান্য প্রিয় বান্দাদের স্বপ্ন, কাশফ এবং ইলহামের মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন।

ইলহাম এর দলীল

"কোনো মানুষের এ মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন, ওহীর মাধ্যম, পর্দার আড়াল অথবা কোনো দূত পাঠানো ছাড়া। তারপর আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান তাই ওহী প্রেরণ করেন। তিনি তো মহীয়ান, প্রজ্ঞাময়।" [কুরআন ৪২:৫১]

এখানে তিনটি পদ্ধতিতে ওহী করার বিষয়ে বলেছেন যে এই মাধ্যমগুলো ছাড়া তিনি কোন মানুষের সাথে কথা বলেন না। আর এই তিন মাধ্যম শুধু মাত্র নবী-রসূলদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে আল্লাহ তায়ালা বার্তা পাঠাতে পারেন।

১) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে হযরত মারইয়াম এর ঘটনা উল্লেখ করেছেনঃ সে বলল, নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রভূর প্রেরিত দূত। আমি তোমাকে পবিত্র একটি ছেলের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য এসেছি। (সূরা মারইয়াম, আয়াত নং ১৯)

সর্বজন বিদিত একটি বিষয় হলো, হযরত মারইয়াম আল্লাহর নবী বা রসূল ছিলেন না। তিনি একজন সত্যবাদী বিদূষী নারী ছিলেন, আল্লাহর ওলী ছিলেন। সুতরাং তিনি যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত হয়েছেন, সেটি জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে জানিয়েছেন।

২) হযরত মূসা (আঃ) এর মায়ের ঘটনা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ আমি মূসার মায়ের কাছে ওহী (ইলহাম) পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাতে থাকো। যখন তুমি তার জীবনের ব্যাপারে আশঙ্কা করবে, তাকে সাগরে নিক্ষেপ করবে আর তুমি কোন চিন্তা ও ভয় করবে না। নিশ্চয়ই আমিই তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে আমার রসূলদের অন্তর্ভূক্ত করবো। (সূরা কাসাস, আয়াত ৭)

হযরত মূসা (আঃ) এর মা নবী ছিলেন না। তার নিকট আল্লাহ তায়ালা যে সংবাদ পাঠিয়েছেন এটিও একটি গায়েবের সংবাদ। অর্থাৎ আমি তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে আনবো এবং তাকে রসূলদের অন্তর্ভূক্ত করবো, এটি গায়েবের বিষয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আঃ) এর মাকে এটি পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছেন।

৩) আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহাফে হযরত খিজির (আঃ) এর সম্পর্কে বলেছেনঃ অতঃপর তারা উভয়ে আমার একজন নেককার বান্দার দেখা পেল, যাকে আমি আমার রহমত দান করেছি এবং আমার পক্ষ থেকে বিশেষ ইলম দান করেছি। (সূরা কাহাফ, আয়াত ৬৫)

হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত খিজির (আঃ) এর ঘটনা সবারই জানা রয়েছে। হযরত খিজির (আঃ) অনেকগুলো ঘটনা ঘটান, যেগুলো সব ছিলো গায়েবের সাথে সস্পর্কিত। এই গায়েবগুলো আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহাফের ৬৫ নং আয়াতে বলেছেন, আমি আমার পক্ষ থেকে তাকে বিশেষ ইলম দান করেছি। এখানে বিশেষ ইলম দ্বারা গায়েবের ইলম উদ্দেশ্য। এ আয়াতের তাফসীরে সকলেই উল্লেখ করেছেন এখানে বিশেষ ইলম দ্বারা গায়েবের ইলম উদ্দেশ্য। কাযী শাওকানী ফাতহুল কাদীরে বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন কিছু গায়েবের সংবাদ দিয়েছেন যা একমাত্র তিনিই জানেন। (ফাতহুল কাদীর, পৃষ্ঠা ৩৯০, বিন্যাসঃ ড. সুলাঈমান আল আশরক, প্রকাশনায়ঃ দারুস সালাম রিয়াদ)

ইমাম বাগাভী (রহ:) এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ আমি তাকে আমার পক্ষ থেকে বিশেষ ইলম শিখিয়েছি অর্থাৎ ইলহামের মাধ্যমে কিছু বাতেনী ইলম শিখিয়েছি। আর খিজির (আঃ) অধিকাংশ আলেমের মতে নবী ছিলেন না। (মায়ালিমুত তানজীল, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৫৮৪)

৪) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেনঃ তিনি তাদের অগ্র ও পশ্চাত সম্পর্কে অবগত। তাঁর ইলমের কোন অংশ কেউ অবগত হতে পারে না, তবে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন অবগত করান। (সূরা বাকারা, আঃ ২৫৫)

ইমাম বাইহাকী রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ তার ইলমের কোন অংশ কেউ জানে না, তবে যাকে ইচ্ছা তিনি তা জানান অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে বিশেষ ইলম শিক্ষা দেন। (আল আসমা ওয়াস সিফাত, ইমাম বাইহাকী রহিমাহুল্লাহ, পৃষ্ঠা ১৪৩)

ইমাম ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ আল্লাহর ইলমের ব্যাপারে কেউ অবগত হতে পারে না, তবে আল্লাহ তায়ালা কাউকে যদি অবহিত করেন তাহলে সে অবগত হতে পারে। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াতের তাফসীর)

৫) আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেনঃ তিনিই অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত। অতএব তিনি তার গায়েবী বিষয় সম্পর্কে কাউকে অবহিত করেন না। তবে তার মনোনীত রসূল ব্যতীত। সেক্ষেত্রে তিনি তার সামনে ও পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন। (সূরা জিন, আয়াত ২৬-২৭)

এ আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এখানে তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা দৃশ্য অদৃশ্য সব কিছু জানেন। কোন সৃষ্টি তাঁর কোন ইলম সম্পর্কে জানতে পারে না, তবে যাকে তিনি জানান কেবল সেই জানতে পারে। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৮৪)

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আমাদের আলেমগণ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা কুরআনের অনেক আয়াতে গায়েব সম্পর্কিত জ্ঞানকে নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। তবে তাঁর নির্বাচিত বান্দাদেরকে কিছু গায়েবের সংবাদ দিয়ে থাকেন। সুতরাং একমাত্র আল্লাহর নিকটই গায়েবের ইলম রয়েছে। গায়েবের ইলম পর্যন্ত পৌছার রাস্তা সম্পর্কে তিনিই পরিজ্ঞাত। তবে তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে গায়েব সম্পর্কে অবহিত করেন, যাকে ইচ্ছা তার থেকে গোপন রাখেন। (তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২)

ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ ফাতহুল বারীতে লিখেছেনঃ কুরআনের স্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) তারা কী খায় ও সঞ্চয় করে সে সম্পর্কে বলেছেন এবং হযরত ইউসুফ (আঃ) তাদের খাদ্যের ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। গায়েব সংক্রান্ত এ বিষয়গুলো অবহিত হওয়ার বিষয়টি পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, তিনিই গায়েব সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। তিনি কারও সম্মুখে গায়েব প্রকাশ করেন না, তবে তার নির্বাচিত রসূল ব্যতীত। কেননা এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, রসূলগণ কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত। আর রসূলের অনুসারী ওলীগণ তাদের কারণেই কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন এবং তাদের মাধ্যমেই সম্মানিত হন। রসূল ও ওলীর কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো রসূল ওহীর মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন, আর ওলী শুধু স্বপ্ন, কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে গায়েব সম্পর্কে অবহিত হন। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৫১৪)

কাযী শাওকানী তাফসীরে ফাতহুল কাদীরে লিখেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা কোন কোন বান্দাকে কিছু কিছু গায়েব সম্পর্কে অবহিত করে থাকেন। (ফাতহুল কাদীর, কাযী শাওকানী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২০)

সংক্ষিপ্ত কথা হলো, গায়েবের চাবিকাঠি একমাত্র আল্লাহর নিকট। তিনি ছাড়া কেউ গায়েব জানে না। তবে ফেরেশতা, নবী রসূল, ওলী ও অন্যান্যদেরকে যদি আল্লাহ তায়ালা গায়েব সম্পর্কে অবহিত করান তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে যতটুকু জানান, তারা কেবল ততটুকুই জানতে পারেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ